আজকাল ওয়েবডেস্ক: নেপালে ‘জেন জি’ বিক্ষোভ দ্রুত অশান্তির রূপ নেয়। প্রতিবাদ প্রথমে সমাজমাধ্যম নিষিদ্ধ করা নিয়ে শুরু হলেও, দুর্নীতি-সহ আরও নানা ইস্যু সেখানে যুক্ত হয়। মঙ্গলবার পরিস্থিতি বদলে যায় চোখের নিমেষে। কাঠমাণ্ডু জুড়ে তাণ্ডব চালায় জেন জি। বিভিন্ন সরকারি ভবনে আগুন, পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, পাঁচবারের নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা এবং তাঁর স্ত্রীর উপর হিংস্র জনতা হামলা চালায়। বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালনাথ খানালের স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী চিত্রকরের ঝলসে মৃত্যু হয়।

সোমবার বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ব্লক করার কারণে ক্ষুব্ধ তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভকারীরা রাজধানী কাঠমান্ডু দখল করে নেয়। যার ফলে পুলিশ ক্ষিপ্ত জনতার উপর গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এর ফলে ১৯ জন নিহত হন।

মঙ্গলবার বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ করেন। তা সত্ত্বেও আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন এবং রাজনীতিবিদদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং কিছু নেতার উপর হামলাও চালায়।

আরও পড়ুন: আন্দোলনকারীদের শান্ত থাকার আবেদন নেপাল সেনার, নাহলে কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি

বিক্ষোভকারীরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের পরিবারকেও রেহাই দেয়নি। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ক্ষিপ্ত জনতা নেপালি কংগ্রেস দলের নেতা শের বাহাদুর দেউবা এবং তাঁর স্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরজু রানা দেউবাকে মারধর করছে। দু’জনেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে যে দলীয় নেতাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নেপালি কংগ্রেস দেশের বৃহত্তম দল এবং শাসক জোটের অংশ।

 দাল্লুতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালনাথ খানালের একটি বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয় একদল জনতা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঘরের ভেতরে আটকা পড়া তার স্ত্রী রাজ্যলক্ষ্মী চিত্রকর গুরুতরভাবে দগ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান বলে জানা গিয়েছে।

কেপি ওলির পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা আগে বিক্ষোভকারীরা বালকোটে নেপালি নেতার ব্যক্তিগত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেল, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল, যোগাযোগমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুং এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখকের সম্পত্তিতে হামলা চালায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নেতার বাড়ি এবং অফিসে আগুন লাগানো হয়েছে। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হওয়ায় নেপালি সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ নেতৃত্ব সংযম এবং সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানিয়ে একটি যৌথ আবেদন জানিয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ক্ষোভ কেবল শুরু ছিল

মঙ্গলবার সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। কারণ, প্রতিবাদীদের মৃত্যু এবং রাজনৈতিক দুর্নীতিতে ক্ষোভ। রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পৌডেল, আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান, বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এবং আরও উত্তেজনা বন্ধ করার জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনি ওলির পদত্যাগ গ্রহণ করেন এবং নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত ওলিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিযুক্ত করেন, যদিও তিনি কোনও ক্ষমতা ব্যবহার করবেন বা তিনি কোথায় থাকবেন তা স্পষ্ট ছিল না।

নেপালে ‘জেন জি’ বিক্ষোভ

নেপাল সরকার যখন ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউব সহ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। সরকারের অভিযোগ ছিল সংস্থাগুলি রেজিস্টার করতে এবং সরকারি তত্ত্বাবধান মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। এর পরেই ‘জেন জি’ প্রতিবাদ নামে বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু বিক্ষোভগুলি ব্যাপক অসন্তোষের প্রতিফলন ঘটায়। বিশেষ করে, অনেক তরুণ ক্ষুব্ধ যে রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানরা, তথাকথিত ‘নেপো কিডরা’ বিলাসবহুল জীবনধারা এবং অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে, যখন বেশিরভাগ তরুণ কাজ খুঁজে পেতে লড়াই করছে।

বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, গত বছর যুব বেকারত্ব প্রায় ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে, সরকার অনুমান করে যে প্রতিদিন ২,০০০ এরও বেশি তরুণ মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কাজ খুঁজতে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নেপালের রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র শাহ। তাঁর শাসনকালও বিতর্কিত ছিল। ২০০৫ সালে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি এবং কড়া হাতে মাওবাদী দমন করায় তাঁকে কড়া সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই সমালোচনা ক্রমে গণআন্দোলনের চেহারা নেয়। ২০০৬ থেকেই এভারেস্টের দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ২০০৮ সালে অবসান হয় রাজতন্ত্রের। দেশে ক্ষমতায় আসে নির্বাচিত সরকার হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের নতুন পরিচয় হয় ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র নেপাল। 

প্রবল দুর্নীতি এবং আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জমা হচ্ছিল ধীরে ধীরে। যারা দিনের পর দিন ধরে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন, তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। গত মার্চ এবং মে মাসে বেশ কিছু সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভও হয়েছিল। কিন্তু ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় সোমবার। ২৩ জন প্রতিবাদীদের মৃত্যুতে। কিন্তু আপাত নিরীহ ‘জেন জি’ এতটা হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠল কেন? দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে কি দেশের সম্পত্তি ভাঙচুর করা যায়? প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং দেশের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বরা তো পদত্যাগ করেই দিয়েছিলেন তারপরেও এই তাণ্ডব কেন? প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।