আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ—যে যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ—তার প্রতিটি অধ্যায়ে সাহস, কৌশল আর বুদ্ধিমত্তার অসাধারণ মিশ্রণ ছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধের একটি অধ্যায় এতটাই বিস্ময়কর যে, শুনলে যে কেউ অবাক হবেন। ভারতীয় নৌবাহিনী সে সময় কন্ডোমকে ব্যবহার করেছিল যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম হিসেবে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন—যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল কন্ডোম, তা-ও একেবারে কৌশলগত প্রয়োজনে। 

ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াইয়ে ব্যস্ত। লক্ষ্য—পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) মুক্ত করা। যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে ভারতীয় নৌবাহিনীর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানের জাহাজ ও সরবরাহ লাইন ধ্বংস করা, যাতে তাদের সেনা ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

‘অপারেশন এক্স’ নামের একটি গোপন অভিযানে ভারতীয় নৌবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজে আঘাত হানার পরিকল্পনা করে। ব্যবহৃত হয় লিম্পেট মাইন নামের বিশেষ জলের নিচের বিস্ফোরক। এই মাইন জাহাজের তলায় বসানো হলে নির্দিষ্ট সময় পর বিস্ফোরিত হয়ে জাহাজ ধ্বংস করতে পারত। কিন্তু সমস্যাটি ছিল—মাইনটি জলের সংস্পর্শে আসার ৩০ মিনিটের মধ্যেই বিস্ফোরিত হতো। ফলে, যারা জাহাজের দিকে সাঁতরে যাচ্ছিল, তাদের প্রাণঘাতী বিপদ তৈরি হচ্ছিল।

নৌবাহিনীর অফিসাররা খুঁজে পান এক চমকপ্রদ সমাধান—কন্ডোম! কারণ কন্ডোম সম্পূর্ণ জলরোধী। ফলে লিম্পেট মাইনের টাইমার অংশে কন্ডোম পরিয়ে দিলে সেটি সঙ্গে সঙ্গে জলের সংস্পর্শে আসত না, এবং বিস্ফোরণ বিলম্বিত হতো। এতে সাঁতারুদের হাতে মাইন সময়মতো পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই অভিনব ধারণা প্রথমে নৌ সদর দপ্তরে বিস্ময় সৃষ্টি করলেও, পরে গোপনে অনুমোদন দেওয়া হয়। দ্রুত কয়েক হাজার কন্ডোম অর্ডার দেওয়া হয়, যা পরে “গোপন অস্ত্র” হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।

আরও পড়ুন: গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর নামে হামাসকে মদত দেওয়ার ছক পাকিস্তানের! ইজরায়েলকে টপকে গাজায় পাক সেনা ঢুকবে শুনেই রেগে আগুন ইজরায়েল...

অপারেশনটিতে ভারতীয় নৌবাহিনী স্থানীয় বাংলাদেশি শরণার্থীদের মধ্য থেকে প্রশিক্ষিত ডুবুরিদেরও ব্যবহার করেছিল। তারা কয়েক কিলোমিটার সাঁতরে গিয়ে পাকিস্তানি জাহাজের নিচে মাইন বসিয়ে ফিরে আসতেন। এই ডুবুরি যোদ্ধাদের অবদানে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আরও ত্বরান্বিত হয়।

এটা প্রথমবার নয় যে কন্ডোম যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সেনারাও তাদের রাইফেলের মুখ ঢাকতে কন্ডোম ব্যবহার করেছিল, যাতে কাদা বা বালু ঢুকে অস্ত্র নষ্ট না হয়। ইতিহাসবিদ অ্যালান আর্চামবাল্টের মতে, এটি ছিল এক সাধারণ কিন্তু কার্যকর সমাধান। আমেরিকান সেনারা কন্ডোম দিয়ে ছোট ছোট বিস্ফোরক বা ফিউজকেও সুরক্ষিত রাখত।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা OSS (যা পরে CIA হয়) পর্যন্ত কন্ডোমকে ব্যবহার করেছিল যান্ত্রিক ধ্বংসের কাজে। তাদের এক ম্যানুয়ালে বর্ণিত রয়েছে, “কন্ডোমের ভেতরে ক্ষয়কারী রাসায়নিক পদার্থ ভরে কোনো ট্রাক বা যন্ত্রের ইঞ্জিনে ঢুকিয়ে দিলে তা কিছু সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যেত।”

ভারতের ‘অপারেশন এক্স’-এর কাহিনি ক্যাপ্টেন এম. এন. আর. সামন্ত ও সাংবাদিক সন্দীপ উনিথনের লেখা বই Operation X-এ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়, কন্ডোমের ব্যবহার শুধু একপ্রকার ‘জুগাড়’ বা হালকা রসিকতার বিষয় ছিল না—এটি ছিল প্রকৃতপক্ষে এক জীবনরক্ষাকারী সমাধান, যা শতাধিক যোদ্ধার প্রাণ বাঁচিয়েছিল।

যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, রক্তপাত ও ত্যাগ। কিন্তু কখনও কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে জেতার মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে মানব মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের এই কনডম কাহিনি সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়—যে, কখনও কখনও সবচেয়ে সাধারণ জিনিসই হয়ে ওঠে ইতিহাসের সবচেয়ে অসাধারণ অস্ত্র।