আজকাল ওয়েবডেস্ক: রামাল্লার এক থিয়েটারের সামনে সোমবার বিকেলে হাজারো মানুষের ভিড় জমেছিল। পুলিশ জনতার উচ্ছ্বাস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। জানালার ফাঁক দিয়ে যখন মানুষজন তাদের দীর্ঘদিনের বন্দি স্বজনদের দেখল, তখনই ভিড় উত্তেজিত হয়ে সামনে ছুটে যায়। কেউ চিৎকার করে প্রিয়জনের নাম নিচ্ছে, কেউ কেঁদে উঠছে আনন্দে।

বাস থেকে নামা প্রতিটি বন্দির মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট—হাড় বেরিয়ে থাকা গাল, তাজা ক্ষতের দাগ, তবু চোখে অদম্য আনন্দ। অনেকে পরিবারের কাঁধে উঠে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে। এক বন্দি মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে চুমু খেতে থাকে—দীর্ঘ ২৪ বছর পর অবশেষে মুক্তি তার।

মোট ৮৮ জন প্যালেস্তিনীয়  বন্দিকে সোমবার ইজরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে পশ্চিম তীরে পাঠানো হয়। অপরদিকে প্রায় ২,০০০ বন্দিকে—যার মধ্যে প্রায় ১,৭০০ জন গাজার বাসিন্দা—গাজায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু লোক পার্শ্ববর্তী দেশেও চলে যাবে বলে জানা গেছে। এই মুক্তি সেই দিনই হল, যেদিন গাজা থেকে শেষ জীবিত ইজরায়েলি বন্দিদের ফেরত দেওয়া হয়। এ ঘটনাকে দুই বছরের যুদ্ধের অবসানের প্রথম ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ইজরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন হামোকেদ-এর অক্টোবর ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, মুক্তির আগে পর্যন্ত ইজরায়েলি কারাগারে ১১,০৫৬ জন প্যালেস্তিনীয়  বন্দি ছিল, যাদের মধ্যে অন্তত ৩,৫০০ জন বিচার ছাড়াই প্রশাসনিক আটক অবস্থায় ছিলেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একটি ডেটাবেসে দেখা গেছে, গাজা থেকে আটক ব্যক্তিদের মাত্র এক-চতুর্থাংশকে যোদ্ধা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: 'গাজায় ঢুকে মারব', যুদ্ধবিরতির পরও হামাসের কার্যকলাপে তিতিবিরক্ত ট্রাম্প, হামাসকে দিলেন হাড়হিম হুমকি!

রামাল্লার জনতার কাছে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে আনন্দের মুহূর্তটাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ—যে দিনটির অপেক্ষায় তারা বছর কাটিয়েছেন। তবে, মুক্তিপ্রাপ্তদের অনেকেই গুরুতর অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন, যেমন হত্যাকাণ্ড বা ইজরায়েলি নাগরিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার অভিযোগে।

ফাতাহ সংগঠনের সদস্য সাবের মাসালমা ২০০২ সালে গ্রেপ্তার হন, মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান। সোমবার তিনি ২৪ বছর পর ঘরে ফেরেন। স্বজনরা তাকে ফোনের ক্যামেরায় দেখিয়ে ভিডিও কলে পরিচয় করিয়ে দেন পরিবারের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে। কেউ ছবি তুলছে, কেউ তার হাত ধরে কাঁদছে। তার এক আত্মীয় বলেন, “ও বলেছিল আমি চিনতে পারব না, কারণ ওজন অনেক কমে গেছে। সত্যিই, এখন ওকে দেখে মৃত মানুষের মতো লাগে। কিন্তু আমরা ওকে আবার জীবিত করব।”


বেশিরভাগ বন্দিই শারীরিকভাবে দুর্বল। কারও মুখে তাজা আঘাতের চিহ্ন, কেউ হাঁটতেও পারছে না অন্যের সাহায্য ছাড়া। এক বন্দি জানিয়েছেন, “পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। শেষ দুই বছর ছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়।” তবে তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিলেন, ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের ভয়ে। ইজরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বেতসেলেম অভিযোগ করেছে, ইজরায়েলি কারাগারগুলোতে প্যালেস্তিনীয়দের ওপর নির্যাতন “নীতিগতভাবে প্রয়োগ” করা হয়। তাদের প্রায়ই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়, অল্প খাবার দেওয়া হয়, এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।


ইজরায়েলি সেনাবাহিনী বন্দিমুক্তির পরদিন থেকেই কঠোর নির্দেশ জারি করে—কোনও ধরণের উদ্‌যাপন চলবে না। ওফার কারাগারের কাছে পরিবার ও সাংবাদিকদের ওপর টিয়ারগ্যাস ছোঁড়া হয়। সামরিক বাহিনীর প্রচারপত্রে লেখা ছিল, “আমরা তোমাদের সর্বত্র নজরে রাখছি। সন্ত্রাসী সংগঠনের সমর্থনে কার্যকলাপ করলে গ্রেপ্তার করা হবে।” রামাল্লার বেশ কয়েকটি পরিবার জানিয়েছে, মুক্তির আগে ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে এসে সতর্ক করে গেছেন যেন পতাকা না ওড়ানো হয়, সভা না করা হয়।

উচ্ছ্বাসের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে হতাশা। অনেক পরিবার, যাদের জানানো হয়েছিল তাদের প্রিয়জন ফিরবেন, দেখলেন তারা নেই মুক্তিপ্রাপ্তদের তালিকায়। দুটি ভিন্ন তালিকা ছড়িয়েছিল—একটিতে পশ্চিম তীরে ফেরার কথা বলা ছিল, অন্যটিতে গাজায় নির্বাসনের নির্দেশ। উম্ম আবেদ নামের এক মহিলা  জানান, তার ভাই কামাল ইমরানের মুক্তির খবর পেয়ে দুই দিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে শোনা যায়, হয়তো তাকে গাজায় পাঠানো হয়েছে। “ওকে ছাড়া আমাদের কিছুই ভালো লাগছে না,” চোখ মুছতে মুছতে বলেন তিনি। “যদি আগে জানাত, মন শক্ত করে নিতে পারতাম। এখন জানিই না, ও কোথায়—গাজা, মিশর না অন্য কোথাও।”

যখন শেষ বাসটি এসে থামে, উম্ম আবেদ ভাইকে না পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। পাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়।রামাল্লার আকাশে তখনও মিশে ছিল কান্না আর আনন্দের সুর—মুক্তির উল্লাসের পাশাপাশি অনিশ্চয়তার দীর্ঘ ছায়া।