আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রাচীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী মানুষরা প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে শুধু স্রোতের ভরসায় ভাসমান ভেলায় যাত্রা করতেন না। তারা তখনই সমুদ্রযাত্রার উপযোগী নৌকা নির্মাণ করছিলেন এবং উদ্ভিদজাত তন্তু ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতেন। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং টিমর-লেস্টের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া পাথরের সরঞ্জাম ও প্রাণীর হাড় সেই পরিকল্পিত সমুদ্রযাত্রার প্রমাণ দেয়।
ট্রেসোলজি, অর্থাৎ সরঞ্জামের মাইক্রোস্কোপিক ক্ষয় ও অবশিষ্ট পদার্থের বিশ্লেষণ, দেখায় যে অনেক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয়েছিল কঠিন গাছের ছাল ও পাতার আঁশ প্রক্রিয়াজাত করার জন্য—যা দড়ি, বাঁধন এবং নৌকার অংশ জোড়ার কাজে লাগানো হতো। 


ফিলিপাইনের মিন্দোরো দ্বীপের বুবগ গুহা, এবং বিলাট গুহা থেকে পাওয়া মাছের হাড় প্রমাণ করে যে সেখানে অন্তত ৩০,০০০ বছর ধরে ধারাবাহিক মাছ ধরার ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল। উপকূল, প্রবাল প্রাচীর এবং জোয়ার-ভাটার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের কৌশলও বদলাত।


ইউজ-ওয়্যার বা সরঞ্জামের ব্যবহারে সৃষ্ট সূক্ষ্ম ক্ষতি, গবেষকদের সাহায্য করে নির্ধারণ করতে কোন সরঞ্জাম কাঠে ব্যবহৃত হয়েছে, আর কোনটি নরম তন্তুতে। এই নিদর্শনগুলো দেখায় কিভাবে প্রাচীন মানুষ দড়ি পাকাতেন, নৌকার ফাঁক সিল করতেন এবং আউটরিগার বেঁধে রাখতেন।

আরও পড়ুন: বাদামি নাকি সাদা, কোন ডিম আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি উপকারী, জেনে নিন এখনই


জেরিমালাই গুহা, পূর্ব টিমরের একটি উপকূলীয় স্থান, এই ইতিহাসের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এখানে পাওয়া গেছে গভীর সমুদ্রের মাছের অবশিষ্টাংশ ও প্রাচীন শাঁসের তৈরি হুক—যা বিশ্বের প্রাচীনতম মাছ ধরার হুক হিসেবে স্বীকৃত। এসব নিদর্শন থেকে বোঝা যায়, নেট ও লাইন তখনকার দৈনন্দিন সরঞ্জামের অংশ ছিল।


সেই স্তরগুলিতে উপকূলীয় ও গভীর সমুদ্রের মাছ একসঙ্গে পাওয়া যায়—যা ইঙ্গিত দেয় সিজন ও পরিবেশ অনুযায়ী পরিবর্তিত মৎস্য শিকারের কৌশলের। এতে প্রতিফলিত হয় এমন এক সমাজ, যারা সাগরের স্রোত, মাছের চলাচল ও ঝুঁকি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখত।


দীর্ঘদিন ধরে ধারণা ছিল যে এই দ্বীপবাসীরা বাঁশের ভেলায় ভরসা করেই স্রোতে ভেসে পারাপার করত। কিন্তু পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টায় দেখা গেছে, শক্তিশালী স্রোতের মুখে এসব ভেলা প্রায়ই ব্যর্থ হয়। ২০২৫ সালে গবেষকরা পুনর্নির্মিত প্রাচীন সরঞ্জাম দিয়ে সিডার কাঠের একটি ডাগআউট ক্যানো বানিয়ে তাইওয়ান থেকে ইয়োনাগুনি পর্যন্ত প্রায় ১৪০ মাইল অতিক্রম করেন মাত্র ৪৫ ঘণ্টায়। কিন্তু বাঁশ বা নলখাগড়ার ভেলাগুলো কুরোশিও স্রোতে টিকে থাকতে পারেনি।


ডাগআউট ক্যানোতে বড় কাঠ ও ভারী কারিগরি দরকার, যা ৪০,০০০ বছর আগের ওয়ালাসিয়া অঞ্চলের ছোট পাথরের টুলস দিয়ে করা কঠিন ছিল। তাই গবেষক ফুয়েন্তেস ও তার সহকর্মীরা ধারণা দেন, প্রাচীন মানুষরা গাছের আঁশ থেকে তৈরি দড়ি দিয়ে যুক্ত বহু-অংশের নৌকা বানাতেন। এসব তন্তু বাঁধা হতো প্ল্যাঙ্ক, আউটরিগার, পাঁজর ও ফ্রেমে—যা দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও দূরপাল্লার সমুদ্রযাত্রা সম্ভব হতো।


এভাবে প্রমাণিত হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন মানুষরা নিছক ভাসমান অভিযাত্রী নয়, বরং তারা ছিলেন দক্ষ নাবিক—যাদের হাতে গড়ে উঠেছিল মানব সভ্যতার প্রথম সমুদ্রযাত্রার ইতিহাস।