আজকাল ওয়েবডেস্ক: ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো শনিবার ভোরে গ্রেপ্তার হয়েছেন। দেশের ফেডারেল পুলিশ অভিযোগ করেছে, তিনি ২০২২ সালের নির্বাচন-পরবর্তী অভ্যুত্থানচেষ্টার মামলায় ২৭ বছরের কারাদণ্ড শুরুর আগে পালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আলেকজান্দ্রে দে মোরায়েসের নির্দেশে ভোর ৬টার দিকে বলসোনারোর ব্রাসিলিয়ার বাসভবনে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।
অ্যাঙ্কল মনিটর ভাঙার অভিযোগে ‘প্রি-এম্পটিভ’ গ্রেপ্তার
বিচারপতি দে মোরায়েস জানান, শনিবার রাত ১২টা ০৮ মিনিটে বলসোনারোর অ্যাঙ্কল মনিটর বা নজরদারি ডিভাইসটি “ভাঙা অবস্থায়” ধরা পড়ে। তিনি এটিকে পালানোর লক্ষণ বলে বিবেচনা করে “প্রিভেন্টিভ অ্যারেস্ট” বা পূর্ব সতর্কতামূলক গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। যদিও বলসোনারোর আইনজীবীরা দাবি করেছেন— “ডিভাইসের কোনও ক্ষতি হয়নি। বিচারপতির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তিনি যে ঘটনার টাইমলাইন তুলে ধরেছেন, তা আসলে এক প্রার্থনা-সভা, কোনও রাজনৈতিক বিক্ষোভ নয়।”
‘পালিয়ে মার্কিন দূতাবাসে যাওয়ার চেষ্টা’— কঠোর মন্তব্য দে মোরায়েসের
রায়ে বিচারপতি উল্লেখ করেন, “বলসোনারো যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলেন। এই দূরত্ব ১৫ মিনিটেই গাড়িতে অতিক্রম করা সম্ভব। তার বিরুদ্ধে থাকা পালানোর আশঙ্কা শুধু বাস্তবই নয়, তাৎক্ষণিক ছিল।” তিনি আরও জানান, অভ্যুত্থান মামলার একাধিক আসামি ও বলসোনারোর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র ইতিমধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছে বা পালানোর চেষ্টা করেছে।
ফ্লাভিও বলসোনারোর ভিডিও: ‘দেশের জন্য লড়বে, না কি সোফায় বসে দেখবে?’
বলসোনারোর গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা আগে তার ছেলে ফ্লাভিও বলসোনারো সামাজিক মাধ্যমে সমর্থকদের রাস্তায় নামতে আহ্বান করেন।
“তোমরা কি দেশের জন্য লড়বে, নাকি বাড়ির সোফায় বসে মোবাইলে দেখবে?” — বলে তিনি সন্ধ্যা ৭টায় তার বাবার বাড়ির সামনে জমায়েত হতে লোকজনকে ডাক দেন। বিচারপতি দে মোরায়েস এই ভিডিওকে ‘‘আইন অবমাননার উস্কানি’’ এবং ‘‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ’’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ইতিহাস বদলে গেল
২০২২ সালের নির্বাচনে লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার কাছে পরাজিত হওয়ার পর বলসোনারো দলীয় সমর্থকদের ব্যবহার করে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছেন— এমন অভিযোগে তিনি ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত। বিচারপতিদের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সেপ্টেম্বরে তাকে ৪–১ ভোটে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে:গণতান্ত্রিক শাসব্যবস্থা ধ্বংসের চেষ্টা, সশস্ত্র অপরাধী সংগঠন পরিচালনা, লুলা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আলকমিনকে হত্যার পরিকল্পনা, সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি দে মোরায়েসকে হত্যা ও অপহরণের ষড়যন্ত্র,বলসোনারো অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বাড়ি থেকে জেলে — আপিল শেষ হলেই কারাদণ্ড শুরু
আগস্ট মাস থেকে বলসোনারো বাড়িতে গৃহবন্দী ছিলেন। তার আইনজীবীরা শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে বাড়িতেই কারাদণ্ড শুরু করার আবেদন করলেও ব্রাজিলের আইন তা অনুমোদন করে না। স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, সোমবার সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির প্যানেল তার গ্রেপ্তার বহাল রাখবেন কি না সে বিষয়ে ভোট দেবেন। সব আপিল শেষ হলে আগামী সপ্তাহেই বলসোনারোকে আনুষ্ঠানিকভাবে কারাগারে নেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া: সমর্থকেরা রাস্তায়, বিরোধীরা উৎসবে
গ্রেপ্তারের পর ব্রাসিলিয়ায় ফেডারেল পুলিশের সদর দপ্তরের সামনে অল্প কিছু সমর্থক জড়ো হলেও পরে বৃহত্তর সমাবেশ হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। অপরদিকে বিরোধীরা সামাজিক মাধ্যমে ‘‘ডেমোক্রেসির জয়’’ বলে উদযাপন শুরু করেছে। ব্রাজিলের বড় শহরগুলোয় ‘উৎসবের আমেজে’ জমায়েতের ডাক চলছে।
বলসোনারো পরিবারের অভিযোগ: ‘রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার’
তার সাবেক প্রেস উপদেষ্টা ও আইনজীবী ফাবিও ওয়াজঙ্গারতেন বলেন, “এটি ব্রাজিলের গণতন্ত্রের জন্য লজ্জাজনক মুহূর্ত। অ্যাঙ্কল মনিটর ভাঙলে তা নয় ঘণ্টা পরে কীভাবে স্বাভাবিকভাবে কাজ করল?” তিনি দাবি করেন, গ্রেপ্তারের রাতে বলসোনারো পরিবার-পরিজনের সঙ্গে স্যুপ খেয়ে ওষুধ খেয়ে আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দলীয় নেতারা বিচারপতি দে মোরায়েসকে ‘‘সর্বোচ্চ মাত্রার মনস্তাত্ত্বিক কর্তৃত্ববাদী’’ বলে অভিহিত করেছেন।
মিশেল বলসোনারো: ‘ব্রাজিলের লড়াই আমরা ছাড়ব না’
ইনস্টাগ্রামে আবেগঘন বার্তায় প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি মিশেল বলসোনারো লেখেন— “আমরা হাল ছাড়ব না। আমাদের জাতির জন্য আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।” তিনি গ্রেপ্তারের সময় ব্রাসিলিয়ার বাইরে ছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: ২০২৬ নির্বাচনে বড় প্রভাব
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রেওমার দে সুজা বলেন, “বলসোনারো পরিবার চেয়েছিল ২০২৬ সালের নির্বাচনকে ‘বলসোনারো-সংক্রান্ত গণভোটে’ পরিণত করতে। এখন তাকে বন্দি করার পর সেই পরিকল্পনা আরও কঠিন হয়ে গেল।”
তিনি যোগ করেন, “বলসোনারো নিষিদ্ধ হওয়ায় ২০২৬ নির্বাচনের জন্য তার পরিবারকে নিজেদের বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে।” বলসোনারোর গ্রেপ্তার শুধু আইনগত ঘটনা নয়— এটি ব্রাজিলের ডানপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যৎ, লাতিন আমেরিকার ক্ষমতার ভারসাম্য এবং গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ককে আরও তীব্র করে তুলেছে।
