আজকাল ওয়েবডেস্ক: শ্রীনগরের জাবরওয়ান পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শত শত কানাল জমি দখল করে কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনী (সিআরপিএফ)-র নতুন ঘাঁটি নির্মাণের উদ্যোগকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক ছড়িয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরে। অভিযোগ উঠেছে, এই প্রকল্পের ফলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা উচ্ছেদের আশঙ্কায় ভুগছেন, আর পরিবেশবিদরা সতর্ক করছেন—‘গ্রিন জোন’-এর ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করলে পশ্চিম হিমালয়ের এই ভঙ্গুর পার্বত্য পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

জাবরওয়ান পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ব্রেইন (Brein) এলাকার বাসিন্দারা জম্মু ও কাশ্মীর প্রশাসনের বিরুদ্ধে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে (NGT) মামলা দায়ের করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এই পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে বেআইনি ভাবে ভূমি সমতলকরণের কাজ চলছে, যেখানে ৫০,০০০-রও বেশি গাছ কাটা হতে পারে সিআরপিএফের ৬১, ৭৯, ১১৭ ও ১৩২ নম্বর ব্যাটালিয়নের ঘাঁটি তৈরির জন্য।

সরকারি নথি অনুযায়ী, গত বছর ২৪ জুন সিআরপিএফ কর্তৃপক্ষ ও শ্রীনগর জেলা প্রশাসনের মধ্যে এক বৈঠকে ১,৩২৪ কানাল জমি (সার্ভে নম্বর ২৭৪৪) ‘ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পিং সাইট’-এর জন্য চিহ্নিত করা হয়। ৮ জুলাই সিআরপিএফের ৭৯তম ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট কিশোর কুমার জেলা প্রশাসককে লেখা চিঠিতে ওই জমির রাজস্ব রেকর্ড চেয়ে পাঠান, যাতে সেখানে প্রবেশপথ নির্মাণের প্রস্তুতি নেওয়া যায়।

এই মামলার মুখ্য আবেদনকারী গুলাম মোহিউদ্দিন শাহ জানিয়েছেন, ৪৯টি পরিবারের প্রতিনিধিত্বে দাখিল করা এই আবেদনটি শুধু জীবিকা নয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্বের প্রশ্নও তুলে ধরেছে। তাঁর বক্তব্য, “যে অঞ্চলটিতে ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা দাচিগাম ন্যাশনাল পার্কের ক্যাচমেন্ট এলাকায় পড়ে, যা ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন, ১৯৮৮ সালের জাতীয় বননীতি এবং শ্রীনগর মাস্টার প্ল্যান-২০৩৫ অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত অঞ্চল।”

দাচিগাম পার্কই হলো বিপন্ন কাশ্মীর হাঙ্গুল হরিণের শেষ আশ্রয়স্থল, যাদের সংখ্যা একসময় হাজারে ছিল, এখন তা কয়েকশোতে নেমে এসেছে। পার্কটি এশিয়াটিক ব্ল্যাক বেয়ার, মস্ক হরিণ ও চিতারও আবাসস্থল। শাহের দাবি, এই নির্মাণকাজ শুরু হলে পুরো পরিবেশ ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।

অন্য আবেদনকারী মহম্মদ রমজান হাফিজ বলেন, প্রথমে সিআরপিএফ ১২৪ কানাল জমির দাবি করেছিল, পরে তা বেড়ে ১,৩২৪ কানালে পৌঁছেছে। তাঁর আশঙ্কা, “আজ যদি এই জমি দেওয়া হয়, কাল তারা আরও ৫,০০০ বা ১০,০০০ কানাল চাইবে। আমরা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে নই, কিন্তু বন ধ্বংস মানে পরিবেশ ধ্বংস।”

গত বছর ব্রেইন এলাকার বাসিন্দারা জম্মু ও কাশ্মীর হাইকোর্টে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁদের মৌলিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৪, ২১ ও ৩০০এ)-এর লঙ্ঘন ঘটছে, এবং কোনও পরিবেশ বা সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরে সিআরপিএফ জানালে যে তারা আপাতত জমি অধিগ্রহণ করছে না, তখন মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি পাহাড়ে লাল রঙে চিহ্নিত পাথর দেখে বাসিন্দারা আবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

শাহ বলেন, “সরকার চাইলে অন্য কোথাও এই ঘাঁটি করতে পারে। কিন্তু বন কেটে ঘাঁটি তৈরি করা মানে স্বর্গকে নরকে পরিণত করা। এমন নীতিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী।”

রাজ্যের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল কনফারেন্স দলও এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। দলের মুখপাত্র ইমরান নবী দার বলেন, “পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে বাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে, কিন্তু চারটি ব্যাটালিয়ন সেখানে রাখার প্রয়োজন নেই। আমরা চাই সরকার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করুক, যাতে পর্যটন কেন্দ্র ও পরিবেশ দুটোই সুরক্ষিত থাকে।”

পরিবেশকর্মী রাজা মুজাফ্‌ফর ভাট বলেন, “গত দুই দশকে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে জম্মু ও কাশ্মীরের বনভূমি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এখন যদি এই পাহাড়ে বিশাল কংক্রিট ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়, তা পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী হবে।” তাঁর মতে, জাবরওয়ান পাহাড় ভূকম্পন ও হঠাৎ বন্যার প্রবণ এলাকা, ফলে ঘাঁটিটি নিরাপত্তার দিক থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ। “সরকারের উচিত জলবায়ু-সহনশীল বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা,” বলেন ভাট।

২০২৩ সালে ইউনিয়ন সরকারের টাকায় প্রকাশিত Springer পত্রিকার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৬৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দাচিগাম ন্যাশনাল পার্ক প্রায় ৮ শতাংশ বন আচ্ছাদন হারিয়েছে। শুধু তাই নয়, পার্কের মূল “কোর জোন”-এর সীমানাও এক-তৃতীয়াংশের বেশি সংকুচিত হয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন আমলাদের নিয়ে গঠিত নাগরিক সংগঠন গ্রুপ অফ কনসার্নড সিটিজেনস (GCC) সরকারকে প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনের সদস্য ও প্রাক্তন বন সংরক্ষক মঞ্জুর আহমদ তাক বলেন, “এই অঞ্চলটি শ্রীনগর মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ‘গ্রিন জোন’, যার ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন করতে হলে আইনগত সংশোধন প্রয়োজন। সরকার যদি প্রকল্পটি এগিয়ে দেয়, তা পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনবে।”

বর্তমানে এই মামলা ২৪ নভেম্বর এনজিটি-তে শুনানির জন্য নির্ধারিত হয়েছে। এদিকে, বন দপ্তর  ও সিআরপিএফ কর্তৃপক্ষ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করেনি। জাবরওয়ান পাহাড়ের প্রকল্পটি এখন জম্মু-কাশ্মীরের রাজনীতি, পরিবেশনীতি এবং স্থানীয় জীবিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।