আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে শুরু হওয়া Special Intensive Revision (SIR) প্রক্রিয়া ঘিরে এখন বড় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মহাগঠবন্দন বা বিরোধী জোট (MGB) অভিযোগ করেছে, এই সংশোধন কার্যক্রম তাদের ভোটব্যাঙ্ককে টার্গেট করে পরিচালিত হয়েছে। প্রশাসন বলছে এটি নিছক রুটিন কাজ, কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে অন্য কথা— বাদ পড়া নামের ধরণ ও সংখ্যা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিকভাবে একপাক্ষিক।

২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে এই বাদ পড়া নামের তথ্য মিলিয়ে দেখা গেছে, মহাগঠবন্দন জেতা আসনগুলোতেই গড়ে অনেক বেশি ভোটার বাদ গিয়েছেন। প্রতিটি MGB জেতা আসনে গড়ে ২০৮ জন বেশি ভোটার বাদ গেছে, NDA জেতা আসনের তুলনায়। মুসলিম ভোটারদের বাদ পড়ার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ— MGB জেতা আসনে গড়ে ৪২১, NDA আসনে ২২৪। বাদ পড়া ভোটারদের মধ্যে মুসলিমদের অনুপাতও বিরোধী আসনগুলোয় অনেক বেশি, ২৭.২ শতাংশ, যেখানে NDA আসনে তা ১৬.৭ শতাংশ।

সবচেয়ে আশঙ্কাজনক দিক হল, এই বাদ যাওয়া নামগুলি রাজ্যজুড়ে সমানভাবে ঘটেনি। এটি বিশেষভাবে কেন্দ্রীভূত হয়েছে সীমান্তবর্তী  অঞ্চলে— কিশনগঞ্জ, আরারিয়া, পূর্ণিয়া, কাটিহার— যেখানে মহাগঠবন্দন ও AIMIM ঐতিহ্যগতভাবে শক্তিশালী। বাদ যাওয়া ভোটারদের শীর্ষ ২৬টি আসনের মধ্যে ১৬টি MGB জেতা, ১টি AIMIM এবং মাত্র ৯টি NDA জেতা আসন। এর মধ্যে ১৭টি (৬৫ শতাংশ) সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অর্থাৎ বাদ যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ভৌগোলিকভাবে একদিকেই প্রবলভাবে কেন্দ্রীভূত, এবং সেটি বিরোধী দুর্গে।

আরও পড়ুন: বিহার ভোটে দ্বিতীয় দফার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করল বিজেপি, রয়েছে বিরাট চমক

এছাড়া দেখা গেছে, যেখানে নির্বাচনের ব্যবধান খুব কম ছিল, সেখানে বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যা বহু গুণ বেশি। যেমন হিলসা আসনে RJD মাত্র ১২ ভোটে জিতেছিল, অথচ সেখানে বাদ গেছে ১,৬৪৩ জনের নাম। একই ছবি দেখা যাচ্ছে রামগড়, সুর্যাগড়া, কুরহানি ও বিক্রমে— সবই MGB জেতা আসন। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র প্রশাসনিক নয়, এর রাজনৈতিক প্রভাব অত্যন্ত গভীর হতে পারে।

উপ-অঞ্চলভিত্তিক তুলনায়ও এই প্রবণতা স্পষ্ট। NDA ঘাঁটি মগধ ও তিরহুত অঞ্চলে বাদ যাওয়ার হার রাজ্যগড়ের নিচে, কিন্তু সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তা দ্বিগুণেরও বেশি। মিথিলা অঞ্চলে গড়ের চেয়ে কিছুটা বেশি বাদ যাওয়া হয়েছে, বিশেষত সীমান্তবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায়।

দলভিত্তিক বিশ্লেষণেও মহাগঠবন্দনের মূল দুই সঙ্গী, RJD ও কংগ্রেস, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কংগ্রেস জেতা আসনগুলোয় বাদ যাওয়া নামের সংখ্যা ও মুসলিম ভোটারদের অনুপাত— দুই-ই রাজ্যের সর্বোচ্চ। অন্যদিকে বিজেপি জেতা আসনগুলোয় বাদ যাওয়ার হার রাজ্যগড়ের নিচে, অর্থাৎ শাসকদলের ভোটব্যাঙ্ক তুলনামূলকভাবে অক্ষত রয়েছে।

জাতিভিত্তিক (SC সংরক্ষিত) আসনগুলোতেও একই প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে, যদিও ব্যবধান কিছুটা কম। মহাগঠবন্দন জেতা সাধারণ আসনে গড় বাদ যাওয়া ১,৬২৪, আর SC আসনে ১,১৭০। NDA জেতা সাধারণ আসনে ১,৩৬৩, আর SC আসনে ১,২২৩। অর্থাৎ বাদ পড়া ভোটারদের সংখ্যার দিক থেকে মহাগঠবন্দন সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে, বিশেষত সাধারণ আসনগুলোয়, যেখানে মুসলিম-যাদব জোট সবচেয়ে প্রভাবশালী।

যদি রাজ্যের গড় বাদ যাওয়া সংখ্যা ধরা হয় ১,৩৮৫, তাহলে দেখা যাচ্ছে মহাগঠবন্দনের ৫১.৮ শতাংশ আসন “উচ্চহারে   বাদ যাওয়া আসন” হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে NDA-র ক্ষেত্রে তা ৩৯.২ শতাংশ। আর “অত্যন্ত উচ্চহারে  বাদ যাওয়া” (২,০০০-এর বেশি) আসনের সংখ্যা MGB-র ২১, NDA-র মাত্র ৫। অর্থাৎ মহাগঠবন্দন জেতা আসনে খুব বেশি ভোটার বাদ পড়ার সম্ভাবনা চার গুণ বেশি।

এই সমস্ত তথ্য একসঙ্গে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ভোটার তালিকা সংশোধনের এই অভিযান বাস্তবে রাজনৈতিকভাবে একতরফা প্রভাব ফেলেছে। এর মূল আঘাত পড়েছে বিরোধী শিবিরের ঘাঁটি— সীমান্তবর্তী এলাকা, RJD ও কংগ্রেস জেতা আসন, এবং মুসলিম-যাদব প্রভাবিত সাধারণ আসনগুলিতে। প্রশাসনিক উদ্দেশ্য যাই বলা হোক না কেন, এই ভোটার বাদ দেওয়ার প্রবণতা নির্বাচনী ভারসাম্য বদলে দেওয়ার মতো বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

বিহারের রাজনীতিতে তাই এখন নতুন স্লোগান ঘুরছে—
“যেখানে জিতেছি, সেখানেই নাম মুছে গেছে।”