আজকাল ওয়েবডেস্ক: ছত্তীসগড়ের বস্তারে সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এবং তথাকথিত ‘নকশাল দমন’ অভিযানের নামে যে হত্যালীলা চলছে, তা নিয়ে গোটা দেশের রাজনৈতিক মহল চুপ করে বসে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান মৃতের সংখ্যা ও স্থানীয়দের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, ভারতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে একটিও আলোচনা হয়নি। অথচ সংসদ তখন অধিবেশনরত।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে, “নকশালমুক্ত ভারত” তৈরির লক্ষ্যে সরকার ‘চূড়ান্ত পদক্ষেপ’ নিচ্ছে। কিন্তু এই ‘পদক্ষেপ’ মানে কী, তা বস্তারে থাকা সাধারণ আদিবাসীরা রোজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন—বাড়ি ঘিরে গুলি চালানো, গ্রামে ঢুকে ধরপাকড়, সন্দেহের বশে নির্বিচারে হত্যা, এবং পরে তা 'মাওবাদী দমন' হিসেবে চালিয়ে দেওয়া।
অপরদিকে, বিরোধী দলগুলোর নীরবতা চোখে পড়ার মতো। যাঁরা বিভিন্ন ইস্যুতে সংসদে সরব হন তাঁরাও এই ইস্যুতে কোনো বক্তব্য রাখেননি। নেই কোনো প্রেস বিবৃতি, নেই কোনো আন্দোলনের ডাক। এমনকি আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বকারী সাংসদরাও নিশ্চুপ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক গভীরতর রাজনৈতিক ঐকমত্যের ইঙ্গিত। বস্তারের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে "রাষ্ট্রবিরোধী" ও "অভ্যন্তরীণ শত্রু" হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে – এমন এক "শত্রু" যার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় নীতি। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া যায়, মনমোহন সিং একসময় নকশালদের "সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি" বলেছিলেন। সেই সূত্রেই সম্ভবত বর্তমান সরকার ‘অভিযান’ চালাচ্ছে—তবে এবার আরও প্রকাশ্যে, আরও নির্মমভাবে।
এই মৌন ঐকমত্যের ইতিহাস নতুন নয়। ইউপিএ সরকারের সময়কার ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’, ইন্দিরা গান্ধীর 'অপারেশন স্টিপলচেজ', অথবা সলওয়া জুডুম—সবকটিই একই ধরণের অভিযানের নিদর্শন। পার্থক্য শুধু সময় ও সরকার পরিবর্তনের। উদ্দেশ্য একই থেকে গিয়েছে।
এমনকি বিচার ব্যবস্থাও এখানে নীরব দর্শক। সুপ্রিম কোর্ট আদিবাসীদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিয়ে নানা ইতিবাচক রায় দিলেও, বাস্তবে তার কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের তিন স্তম্ভ—বিচার বিভাগ, আইনসভা ও নির্বাহী—এই ইস্যুতে কার্যত এক মঞ্চে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সমাজ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি সেই "গোপন ঐকমত্য" যার ভিত্তিতে ভারতীয় গণতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এক ভয়—যা রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একত্রিত করে। এই ভয়ই তৈরি করে সেই ‘শত্রু’র চিত্র—যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে সব রকম আইনি ও নৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দেওয়া যায়, গণতন্ত্রের আড়ালে চালানো যায় দমনপীড়ন।
এই নিরব হিংসার স্বরূপ বুঝে তবেই সম্ভব হবে বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া। বস্তারের হত্যালীলা আমাদের বাধ্য করছে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতরে থাকা গোপন সঙ্কটকে দেখতে।
 
 এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো—এই ‘মৌন সহমত’ ভাঙবে কবে? আর আদৌ ভাঙবে কি?
