আজকাল ওয়েবডেস্ক: ১৫ জুলাই সন্ধ্যা। ৩৭ বছরের ইটভাটার শ্রমিক তাহের আলি বসে ছিলেন ছরুয়াবাখরা গ্রামের এক তারপোলিনের তাবুর ভেতর। এক সপ্তাহ আগেই—৮ জুলাই—জেলার প্রশাসন তাঁর ও আশপাশের হাজারো মানুষের ঘরবাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দিয়েছে। সেই অবস্থায় তাঁর ফোনে এল একটি বার্তা— "Thank you for submitting form on VSP. Your reference ID is… ECI"। লেখাপড়া না জানার কারণে তাহের আলি ছুটে গেলেন পড়াশোনা জানা এক প্রতিবেশীর কাছে। জানা গেল, ভোটার তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ‘ফর্ম ৭’ আপলোড করা হয়েছে। এই ফর্ম সাধারণত কারও নাম অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করতে ব্যবহৃত হয়।
ঘর ভাঙা থেকে ভোটার তালিকা মুছে দেওয়া: এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া
৮ জুলাই ধুবরি জেলার বিলাসিপাড়া মহকুমার ছাপর রাজস্ব চক্রের প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চিহ্নিত জমিতে সরকারি অভিযান চলে। স্থানীয়দের দাবি—২,০০০ বাড়ি ভাঙা হয়। প্রশাসনের হিসাবে ১,৪০০। উচ্ছেদ হওয়া অধিকাংশ পরিবারই পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম বংশোদ্ভূত। ১৫ জুলাইয়ের সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রকাশ্যে বলেন— "যাদের উচ্ছেদ করেছি, তাদের নাম ভোটার তালিকা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে বা দেওয়া হবে।" তিনি এই উচ্ছেদ অভিযানের যুক্তি দিয়েছেন কথিত ‘ভূমি জিহাদ’ ঠেকানোর জন্য, এবং ঘোষণা করেছেন এটি ‘জাতি, মাটি, ভেটি’ রক্ষার পদক্ষেপ।
কিন্তু বাস্তবে এই মানুষগুলোর অনেকে বহু দশক ধরে এখানে বসবাস করছেন। তাহের আলির বাবা কাশেম আলি বহু বছর আগে পূর্ববর্তী ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে এখানকার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তাহেরের অভিযোগ— "প্রথমে আমাদের ঘর ভাঙল, এবার ভোটাধিকার কেটে দিচ্ছে। আমি পরিযায়ী শ্রমিক—যেখানেই কাজ করতে যাই, ভোটার আইডি চাইবে। সেটাই যদি না থাকে, কিভাবে চলবে?"
ক্ষতিপূরণ নিয়েও বিতর্ক
জমিহীন পরিবারগুলিকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ও নতুন এলাকায় পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ অনেক চেক মৃত বা দীর্ঘদিন পরিবারপ্রধান নন এমন ব্যক্তির নামে ইস্যু হয়েছে। পরিবারের বিভাজন অনুযায়ী আলাদা পরিবার হলেও চেক একটি পরিবারের নামে দেওয়া হয়েছে। সরকারি হিসাব ও বাস্তবের সংখ্যায় বিশাল ফারাক—সরকার বলছে ১,৪০০ পরিবার উচ্ছেদ, মহকুমা অফিসারের হিসাবে ১,০৮০, কিন্তু ক্ষতিপূরণের চেক পেয়েছে মাত্র ৮০০ পরিবার। হায়েত আলির অভিযোগ—চেকে তাঁর নাম ভুল লেখা হয়েছে (‘হায়েদ’ আলি), ফলে ব্যাংক টাকা দেবে না।
ভোটার তালিকা থেকে নাম মুছে ফেলার নোটিস
ছরুয়াবাখরা, সন্তোষপুর, চিরাকুটা পার্ট-১ ও পার্ট-২—এই চারটি গ্রামে মোট ভোটার আনুমানিক ৩,৮০০। বুথ লেভেল অফিসারের তথ্যমতে, শুধুমাত্র ছরুয়াবাখরা ও সন্তোষপুরেই অন্তত ১,২৬০ জনের নামে ফর্ম ৭ আপলোড করা হয়েছে—যাদের নাম মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে উচ্ছেদের পরপরই। অনেকেই জানেন না তাঁদের নাম মুছে দেওয়া হচ্ছে কিনা— ফোন নম্বর ভোটার আইডির সঙ্গে যুক্ত নয়। নম্বর বদলে গেছে বা আত্মীয়ের নম্বর দেওয়া আছে। অশিক্ষার কারণে ইংরেজি বার্তা বুঝতে পারছেন না। প্রথমবার ভোট দেওয়ার কথা ছিল এমন তরুণদের মধ্যেও আতঙ্ক—যেমন চান আলি, জহুর আলি ও কঞ্চন খাতুন। চান আলি বলেন— "যদি নাগরিকত্বই অস্বীকার করা হয়, জীবনভর সমস্যা পোহাতে হবে।"
আরও পড়ুন: এত দূরে চাকরি করতে কেন এসেছ? না চাইতেই মহিলা যাত্রীর সেই 'চাহিদা' মেটালেন অটোচালক!
জমি অধিগ্রহণ ও পুলিশি দমন
অসম বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা (APDCL) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ৩,৫০০ বিঘা জমি চিহ্নিত করেছে, এলাকায় সাইনবোর্ড লাগিয়েছে—“এই জমি APDCL-এর, অনুমতি ছাড়া প্রবেশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।” মিয়াদি পট্টাধারীদের কাছেও জমি অধিগ্রহণের নোটিস এসেছে—১৫ দিনের মধ্যে আপত্তি জানাতে হবে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষের অভিযোগ—পুলিশ বারবার তাবু ভেঙে দিচ্ছে, খাবার নষ্ট করছে, রান্নার হাঁড়ি-বাসন কেড়ে নিচ্ছে, এমনকি মারধরও করছে।
আইনি প্রশ্ন
১৯৫০ সালের জনগণ প্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা থেকে নাম মুছে দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নোটিস দিয়ে শুনানির সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া, ১৯৬০ সালের ভোটার নিবন্ধন নিয়ম অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে যাচাই ও জনসমক্ষে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ অপরিহার্য। বাস্তবে উচ্ছেদ হওয়া বহু মানুষ জানাচ্ছেন—এসব কিছুই হয়নি। আইনজীবীরা বলছেন—ঘরবাড়ি ভাঙা ও সঙ্গে সঙ্গে ভোটাধিকার কেটে দেওয়া, আসন্ন নির্বাচনের কয়েক মাস আগে, সংবিধানসম্মত অধিকার হরণ।
অনিশ্চয়তার ছায়া
তপ্ত রোদ, তাবুর নীচে গরমে দমবন্ধ, খাবার ও পানীয় জলের অভাব, শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, আর উপরে ভোটাধিকার হারানোর ভীতি—এই চার গ্রামের মানুষের জীবন এখন স্থায়ী আতঙ্কে। তাহের আলির কথায়— "আমরা জানি না কাল কী হবে। ঘর গেল, এখন ভোটও যাবে কিনা, সেই ভয় নিয়েই বেঁচে আছি।"
