প্রায় এক শতাব্দীর যাত্রা, ভারতীয় গর্বের প্রতীক এই ক্রিম

img

আন্তর্জাতিক বিউটি ব্র্যান্ডগুলির আগমনের বহু আগেই ভারতীয় ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছিল এক সাধারণ সবুজ টিউব। টিউবটি শুধু একটি ওষুধই ছিল না, বরং বয়ে এনেছিল স্বদেশি আন্দোলনের চেতনা। সেই টিউবের নাম—বোরোলিন। প্রায় পঁচানব্বই বছর পরও এই সর্বগুণসম্পন্ন ক্রিম আজও রয়েছে আমাদের ওষুধের বাক্সে, চুপচাপ সঙ্গী হয়ে কাটাছেঁড়া, পুড়ে যাওয়া, ফাটা গোড়ালি কিংবা নানা রকম চর্মসমস্যায়।

img

বোরোলিনের সূচনা ১৯২৯ সালে। কলকাতার ব্যবসায়ী গৌরমোহন দত্ত, যিনি তখন বিদেশি ওষুধ আমদানি করতেন, স্থাপন করেন জিডি ফার্মাসিউটিক্যালস। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় স্বদেশি পণ্যের ডাক শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন এমন একটি দেশীয় ওষুধ তৈরি করবেন, যা বিদেশি ব্র্যান্ডের সমতুল্য মান বজায় রাখবে, আবার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেও থাকবে।

img

ফলস্বরূপ জন্ম নেয় এক অনন্য মিশ্রণ—বোরিক অ্যাসিড, ল্যানোলিন আর জিঙ্ক অক্সাইডের সংমিশ্রণ, যা ত্বকের নানা সমস্যার সমাধান দিল সহজেই।

img

প্রথম যাত্রা ছিল সহজ নয়। ব্রিটিশরা দেশীয় শিল্পকে বাঁধা দিতে চেষ্টা করে। তবুও বোরোলিন তার জায়গা করে নেয় ভারতের ঘরে ঘরে। কাশ্মীরের হিমশীতল শীত হোক বা কেরালার আর্দ্র গরম—সব জায়গাতেই এটি হয়ে ওঠে ভরসার নাম।

img

প্রথম উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হয় পশ্চিমবঙ্গের চাকবাগির ২০ একর জমির উপর। পরে দ্বিতীয় ইউনিট গড়ে ওঠে গাজিয়াবাদের মোহন নগরে। সময়ের সঙ্গে জিডি ফার্মাসিউটিক্যালস নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনে—সুথল অ্যান্টিসেপ্টিক লিকুইড, ইলান হেয়ার অয়েল, গ্লোসফট ফেসওয়াশ, প্যানরব লিকুইড পেইন রিলিভার। কিন্তু ব্র্যান্ডের আসল পরিচয় হয়ে থেকে যায় বোরোলিন। বিশেষত শীতকালে এর চাহিদা সর্বোচ্চে পৌঁছায়।

img

“বোরো” শব্দ এসেছে বোরিক পাউডার থেকে, আর “লিন” এসেছে লাতিন শব্দ ওলেইন থেকে। আর এর হাতির লোগো, যা ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অপরিবর্তিত, প্রতীক হয়েছে শুভ আর শক্তির। অনেকেই এখনও একে ভালোবেসে বলেন—“হাতির ক্রিম”।

img

ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এর ইতিহাস। ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭-এ, প্রতিষ্ঠাতার পুত্র দেবাশিস দত্ত, যিনি তখন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন, দেশের স্বাধীনতা উদযাপনে এক লক্ষেরও বেশি বোরোলিন টিউব বিনামূল্যে বিতরণ করেন। কলকাতার সংবাদপত্রে স্বাধীনতার বিজ্ঞাপনের পাশে বোরোলিনের বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়, যেন স্বাধীনতার আনন্দে এক সাথেই ভাগ নিল এই স্বদেশি ব্র্যান্ড।

img

সময়ের সঙ্গে এই ক্রিম জায়গা করে নেয় বহু নেতা ও তারকার জীবনে। এমনকি জওহরলাল নেহরু এবং ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় তারকারাও নিয়মিত ব্যবহার করতেন এটি। আজও এর ব্যবহার ভারতের বাইরে গিয়ে পৌঁছেছে ওমান, তুরস্ক, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে।

img

প্রায় এক শতাব্দী পরও, বোরোলিন শুধু একটি ওষুধ নয়, বরং একটি ঐতিহ্য, এক টুকরো ভারতীয় ইতিহাস। স্বাধীনতার চেতনা, গৃহস্থালির ভরসা আর স্বদেশি শিল্পের প্রতীক হিসেবে আজও এটি প্রতিটি প্রজন্মের কাছে অমূল্য সম্পদ।