ছট পূজা: সূর্য উপাসনার বিজ্ঞান, পুরাণ ও প্রকৃতি-সচেতনতার অসাধারণ সমন্বয়
সুমিত চক্রবর্তী
রবিবার, 26 অক্টোবর 2025
1
9
গভীর ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পালিত ছট পূজা ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব হিসেবে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সূর্যদেব সূর্য ও দেবী ছঠী মাইয়া-র উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই চার দিনের হিন্দু সূর্য উৎসব কেবল ভক্তি নয়, বরং বিজ্ঞান, প্রকৃতি, এবং সংস্কৃতির এক চমৎকার সংমিশ্রণ। উপবাস, নদীর ঘাটে আরাধনা, ও অস্ত-উদীয়মান সূর্যকে অর্ঘ্য দেওয়ার পরিচিত রীতির বাইরেও এই উৎসবের রয়েছে বহু বিস্ময়কর দিক, যা প্রাচীন জ্ঞান ও আধুনিক জীবনের মধ্যে এক সেতুবন্ধন রচনা করে।
2
9
পুরাণে প্রাচীন উৎস: ছট পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় উভয় মহাকাব্যেই — রামায়ণ ও মহাভারত। রামায়ণে বলা হয়েছে, মাতা সীতা লঙ্কা বিজয়ের পর অযোধ্যায় ফিরে এসে সূর্যদেবের উপাসনা ও উপবাস করেছিলেন মাতৃত্ব ও সমৃদ্ধির আশীর্বাদ কামনায়। অন্যদিকে মহাভারতে, সূর্যদেবের পুত্র কর্ণ প্রতিদিন নদীর জলে দাঁড়িয়ে সূর্যকে প্রণাম করতেন, যা আজকের ছট পূজার মূল আচার ‘অর্ঘ্য দান’-এর সঙ্গে অদ্ভুত মিল রাখে। এই কাহিনিগুলি ছট পূজার বৈদিক প্রাচীনতা ও পুরাণভিত্তিক তাৎপর্য প্রমাণ করে।
3
9
মূর্তি বা পুরোহিতহীন উপাসনা: ছট পূজার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হল এর সরলতা ও নিঃস্বার্থতা। এই পূজায় কোনও মূর্তি, মন্দির বা পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি আচার নিজে হাতে সম্পন্ন করেন ভক্ত বা “বরতী”-রা। তারা নিজেরাই ফলমূল সাজান, নদীতে দাঁড়িয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য দেন, প্রার্থনা করেন। এই সরাসরি সংযোগের মধ্য দিয়েই ছট পূজা এক অনন্য ধর্মীয় অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে— যেখানে ভক্ত ও দেবতার মধ্যে কোনও মধ্যস্থতা নেই।
4
9
অস্ত ও উদীয়মান সূর্যের দ্বৈত পূজা: বিশ্বের বেশিরভাগ সূর্যোপাসনায় কেবল উদীয়মান সূর্য-কেই আরাধনা করা হয়, কিন্তু ছট পূজা অনন্য— এখানে অস্ত সূর্য (সন্ধ্যা অর্ঘ্য) এবং উদীয়মান সূর্য (ঊষা অর্ঘ্য) উভয়কেই সমানভাবে পূজা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় জীবনের চক্রাকার গতি, শক্তির ভারসাম্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের গভীর সম্পর্ক। সূর্যাস্তের কৃতজ্ঞতা ও সূর্যোদয়ের নতুন আশাকে একত্রে শ্রদ্ধা জানানোই এই দ্বৈত উপাসনার মূল দর্শন।
5
9
৩৬ ঘণ্টার কঠোর নিরাহার উপবাস: ছট পূজার “বরত” বা উপবাস ভারতীয় ধর্মীয় আচারগুলির মধ্যে সবচেয়ে কঠোর হিসেবে পরিচিত। ভক্তরা টানা ৩৬ ঘণ্টা জল ও আহার ত্যাগ করে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থাকেন। এই উপবাস কষ্ট নয়, বরং আত্মসংযম ও পবিত্রতার এক প্রতীক। বিশ্বাস করা হয়, এই নিয়মিত অনুশীলন শরীর ও মন উভয়কেই পরিশুদ্ধ করে, জীবনের প্রতি গভীর আত্মনিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি করে।
6
9
বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যগত তাৎপর্য: ছট পূজার অনেক দিকই আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সূর্যের দিকে মুখ করে নদীর জলে দাঁড়ানো শরীরে সূর্যালোক শোষণ এবং ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে। দীর্ঘ উপবাস শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে— যা আধুনিক “ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং”-এর সঙ্গে মিল রাখে। পাশাপাশি, পরিশুদ্ধ পরিবেশ, গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস ও নিয়মিত ধ্যান মনোযোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
7
9
পরিবেশবান্ধব উৎসব: ছট পূজা প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রতীক। এতে ব্যবহৃত সব উপকরণ— যেমন মাটির প্রদীপ, বাঁশের সূপ, মৌসুমি ফল, আখ ও ধান— সম্পূর্ণভাবে জৈব ও পরিবেশবান্ধব। নদী, পুকুর বা ঘাটের জলে পূজা করা প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের ঐক্যের প্রতীক। আজকাল শহরাঞ্চলেও কৃত্রিম ঘাট ও ইকো-ফ্রেন্ডলি পুকুর তৈরি করে দূষণ রোধের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
8
9
স্থানীয় শিল্প ও অর্থনীতির সংরক্ষণ: ছট পূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতি ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পেরও পুনর্জাগরণ ঘটায়। বাঁশশিল্পী, মৃৎশিল্পী ও ক্ষুদ্র কৃষকরা এই উৎসবের মাধ্যমে জীবিকা পান। ফল, আখ, চাল, ও মাটির দ্রব্যের চাহিদা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। এইভাবে ছট পূজা একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক চক্রের ভারসাম্য রক্ষা করে।
9
9
ছট পূজা তাই শুধু এক ধর্মীয় আচার নয়— এটি পুরাণ, বিজ্ঞান, পরিবেশ ও সংস্কৃতির এক মহাসংগীত, যা মানুষকে শেখায় কৃতজ্ঞতা, আত্মসংযম ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। বৈদিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এই উৎসব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়— সৌর শক্তি ও প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের চিরন্তন বন্ধন কখনও ম্লান হয় না।