পৃথিবীর পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত রাডার স্যাটেলাইট নিসার। নাসা ও ইসরো যৌথভাবে নির্মিত এই উপগ্রহের প্রথম পরীক্ষামূলক ছবি ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে—কীভাবে এটি কৃষিক্ষেত্রের স্বাস্থ্য নিরীক্ষা থেকে শুরু করে ভূমিকম্প–ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত, পৃথিবীকে দেখার পদ্ধতিকে আমূল বদলে দিতে পারে।
2
12
২০২৫ সালের ৩০ জুলাই ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো নিসারকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। আগস্টের শেষদিকে স্যাটেলাইটটির রাডার সিস্টেম প্রথমবার চালু করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৬৪ মাইল (৭৪৭ কিলোমিটার) উচ্চতায় কক্ষপথে ঘুরছে।
3
12
প্রথম দফায় প্রাপ্ত নিসারের রাডার চিত্রগুলো বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করেছে। একটি ছবিতে ধরা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মেইন উপকূলের কাছে অবস্থিত মাউন্ট ডিজার্ট আইল্যান্ড। ছবিতে গাঢ় অংশে দেখা যাচ্ছে জলাশয়, সবুজ অংশে বনভূমি এবং উজ্জ্বল ম্যাজেন্টা রঙে ফুটে উঠেছে ভবন, পাথর বা খোলা ভূমি। এমনকি অতি সরু জলপথ ও ছোট ছোট দ্বীপও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে—যার প্রস্থ মাত্র কয়েক ফুট। এই সূক্ষ্মতা প্রমাণ করছে নিসারের সেন্সর কতটা নিখুঁতভাবে কাজ করছে।
4
12
আরেকটি পরীক্ষামূলক চিত্রে দেখা গেছে নর্থ ডাকোটা অঙ্গরাজ্যের উত্তর–পূর্বাঞ্চল। সেখানে গ্র্যান্ড ফর্কস ও ওয়ালশ কাউন্টি অতিক্রম করে প্রবাহিত ফরেস্ট নদীর ধারে বন ও জলাভূমি এবং তার দুপাশে বিস্তৃত কৃষিজমি ধরা পড়েছে। বৃত্তাকার সেচের ধরণ, বিভিন্ন ফসলের প্রকারভেদ—যেমন কোথাও পতিত জমি, কোথাও সয়াবিন বা ভুট্টা—সবই রাডার চিত্রে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
5
12
নিসার প্রচলিত ক্যামেরাভিত্তিক স্যাটেলাইট নয়। এটি মাইক্রোওয়েভ রাডার ব্যবহার করে পৃথিবীর পৃষ্ঠ স্ক্যান করে। উপগ্রহটি মাটিতে সংকেত পাঠায়, যা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। সেই প্রতিফলনের সময় ও তীব্রতা বিশ্লেষণ করে মাটির আর্দ্রতা, বনভূমির ঘনত্ব, এমনকি মেরু অঞ্চলের বরফের পরিবর্তনও শনাক্ত করা যায়।
6
12
নিসারের দুটি রাডার সিস্টেম রয়েছে—এল–ব্যান্ড ও এস–ব্যান্ড। এল–ব্যান্ড রাডার, যা নির্মাণ করেছে নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি, দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্য (প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার) ব্যবহার করে। এর ফলে এটি গাছের ছাউনির ভেতর পর্যন্ত দেখতে পারে এবং ভূমির সামান্যতম নড়াচড়াও শনাক্ত করতে সক্ষম। ভূমিকম্প, ভূমিধস কিংবা আগ্নেয়গিরির পরিবর্তনের আগ–পশ্চাৎ বিশ্লেষণে এটি অমূল্য ভূমিকা রাখবে।
7
12
অন্যদিকে, এস–ব্যান্ড রাডার, যা ভারতের স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার তৈরি করেছে, সূক্ষ্ম উদ্ভিদ ও কৃষিজ ফসল পর্যবেক্ষণে বেশি কার্যকর। এটি ফসলের বৃদ্ধি, পরিবর্তন বা মৌসুমি বৈচিত্র্য নিরীক্ষণে বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
8
12
এই দুটি রাডার একসঙ্গে কাজ করে পৃথিবীর ভূমি ও বরফ–আবৃত পৃষ্ঠকে প্রতি ছয় দিনে দুইবার স্ক্যান করবে। এর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে বিশালাকার ১২ মিটার (৩৯ ফুট) প্রশস্ত অ্যান্টেনা—যা নাসার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কক্ষপথে স্থাপিত রাডার অ্যান্টেনা।
9
12
এই মিশন বহু বছরের পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ফল। ইসরো নির্মাণ করেছে স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো ও উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা, আর নাসা সরবরাহ করেছে রাডার সিস্টেম ও ডেটা যোগাযোগ প্রযুক্তি।
10
12
নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেছেন, “এটি কেবল শুরু। নিসার আমাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং মহাকাশবিজ্ঞানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করবে।”
11
12
নাসার বিজ্ঞান মিশন ডিরেক্টরেটের সহযোগী প্রশাসক নিকি ফক্স যোগ করেন, “এই প্রাথমিক চিত্রগুলো নিসারের প্রকৃত ক্ষমতার এক ঝলক মাত্র। পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম শুরু হলে এটি পৃথিবীর পরিবর্তনশীল ভূমি ও বরফ–পৃষ্ঠ সম্পর্কে অভূতপূর্ব তথ্য সরবরাহ করবে।”
12
12
নভেম্বর মাস থেকে নিসারের পূর্ণ বৈজ্ঞানিক অভিযান শুরু হওয়ার কথা, আর বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই আশাবাদী—এই যুগান্তকারী স্যাটেলাইট পৃথিবী পর্যবেক্ষণের মানচিত্রই পাল্টে দেবে।