ভূত চতুর্দশী নামটির মধ্যেই একটি গা ছমছমে ব্যাপার লুকিয়ে রয়েছে। সকল মতেই এই দিন মর্তলোকে অশুভ শক্তির আগমনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলে, বছরে স্রেফ এই একটি দিন তেনাদের, কেউ কেউ অবশ্য বলে সব দিনই তেনাদের, শুধু  চোখ-কান খুলে সতর্ক হয়ে গা বাঁচিয়ে চললেই হল। ভূত চতুর্দশী নিয়ে অথবা ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকেরই নানান অভিজ্ঞতা আছে বলে শোনা যায়।  এবার এমনই  অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা শোনালেন বর্ষীয়ান জনপ্রিয় অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ভূত ও ভয় নিয়ে ভাগ করে নিলেন তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস। 

 

ভয় আলাদা করে পাওয়ার কী আছে? ভয় তো মানুষের মধ্যেই আছে। হাসি, কান্না, হতাশার মতো ভয় পাওয়াও একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বাইরের কোনও উপাদান সেটাকে একটু চাগাড় দেয়, এই যা! বাইরের কোন জিনিসটা দেখে বা শুনে ভয় পাবেন আপনি, তা কেবল আপনার উপরেই নির্ভর করে। আর ভূতের  ভয়? সেটা তো মানুষ ভয় পাওয়ার জন্য ভূত দেখার চেষ্টা করে। অনেক আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে রাখে। ভূত বলে কিস্যু নেই! 

 

ভূত দেখার জন্য সাধারণত মানুষ নিজের মনেই একটা গল্প প্রস্তুত করে রাখে। ভেবেই নেয়, ওটাই ভূত, ভূতের জন্যই হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের দিকে তো ভূতের ভয় আরও বেশি, ভূতুড়ে সব অভিজ্ঞতা ভূরি ভূরি। চাঁদনী রাতে অল্প জ্যোৎস্না এসে পড়ছে শুকনো কলাগাছের উপর, অল্প আলোয় সেই পাতা হয়তো দুলছে ব্যস!  ভেবে নিল কোনও সাদা থান পরা মহিলা উপুড় হয়ে বসে আছে। আবার এমন আলো-আঁধারি পরিবেশে কোনও শুকনো কলাগাছের পাশে যদি কোনও ছোট্ট, সরু গাছ থাকে তা চট করে দেখে মনে হয় কেউ রোগা হাত বাড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে! দ্রুত সেই ভয় ছড়িয়ে আকার নেই লোককথায় এবং ঘটনায়। অর্থাৎ ভয় পাওয়ার জন্য ভয় পাচ্ছে।


এবার বলি, শহরাঞ্চলের কথা। আমার পরিচিতি এক বাড়ি। অনেক বছর আগেকার কথা। তা সেই বাড়িতে একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো ছিল। পরপর বেশ কয়েকদিন  গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত, আচমকা সেই পিয়ানো টুং টাং শব্দে বেজে উঠত। অথচ সেই বন্ধ ঘর খুলে,  আলো  জ্বালিয়ে দেখা যেত  সব ভোঁ ভাঁ! কিচ্ছু নেই, কেউ নেই। দ্রুত জাঁকিয়ে বসল ভয়। ফিসফিসানি শুরু হল, কোনও শিল্পীর অতৃপ্ত আত্মা কি তাহলে পিয়ানো বাজিয়ে যাচ্ছে? নিজের অতৃপ্ত সাধ পূরণ করছে? আর প্রায়ই ঘটতে থাকল এই ঘটনা। গোটা মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ল ওই পিয়ানো-ভূতের আতঙ্ক। রসালো আলোচনা হতে লাগল। এবার ওই বাড়ির একটি শিশুর জ্বর হওয়াতে তাঁদের পারিবারিক ডাক্তার হাজির হলেন একদিন। গোটা ঘটনাটি তিনি শুনে যেই না ঢুকেছেন পিয়ানো ঘরে, ওমনি সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন। যাই হোক, ডাক্তারবাবু গিয়ে যেই না পিয়ানোর ঢাকনাটা খুললেন, অমনি সব 'হাত দেবেন না, হাত দেবেন না' বলে চিৎকার করে একসা, মানে যাঁরা ভূতকে ভালবাসে আর কী।

যাই হোক, পিয়ানো খুলে দেখা গেলো, টুকরো টুকরো কাগজের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট ইঁদুরছানার দল শুয়ে। বোঝা গেল, ছানাদের খাওয়াতে গভীর রাতে মা ইঁদুর ওই পিয়ানোর মধ্যে ঢোকে, ফলে কডগুলো বেজে ওঠে তার পায়ের চাপে! আবার যখন খাইয়ে দিয়ে সে চলে যায়, ফের পিয়ানোর সুরেলা আওয়াজ বেজে ওঠে...তারপর আর কী ওই বাড়ির মানুষদের মনে কী কষ্ট। এ বাবা, ভূত তাহলে নেই, ভূতের ব্যাপারটা চলে গেল। এই তো ব্যাপার।  হাসতে হাসতে বলে উঠলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা। 

শেষ করি, আমার ছোটবেলার কথা দিয়ে। মানে, ছোটবেলার ভয় পাওয়ার কথা দিয়ে। গ্রামে থাকতাম। ঝড়ে চাল উড়ে গিয়েছে বাড়ির, খড়ের গাদার উপর শুয়ে রয়েছি একা। বেশ খানিকটা দূরে দাদু-দিদিমা রয়েছেন যদিও। চারপাশে ঝুপসি অন্ধকার। গাছপালাগুলোর উপর ও নীচে এত চাপ চাপ অন্ধকার যে দেখে গা শিরশির করে ওঠে। মানে ছায়া ছায়া অন্ধকার আর কী! আর অখন্ড নিঃস্তব্ধতা চারপাশে। আর এর মধ্যে সেই শান্ত পরিবেশ খানখান করে কোথা থেকে একটা হুতোম প্যাঁচা ডেকে উঠছে, ওরকম গম্ভীর স্বরে। অন্ধকারে, ফাঁকা প্রান্তে প্রায় একাকী অবস্থায় যে না হুতোমের ডাক শুনেছে সে বুঝতে পারবে না ওই আতঙ্ক! আমিও তখন ভয় পাচ্ছিলাম, কিন্তু যেই ওই ডাক বন্ধ হচ্ছিল খানিক স্বস্তি পেয়েই আবার উৎসুক হচ্ছিলাম কখন আবার ওই ডাক শুনতে পাব। মানে বলতে চাইছি, উপভোগ করছিলাম ভয়টাকে আবার কেমন যেন শিরশিরানিও লাগছিল। আসলে ভয় আর ভয় জয় করাটাও দু'টোই সাবজেকটিভ। মনের দুর্বলতা ভয় আর সবলতা-ই তাকে জয় করা।