আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেন্দ্রের ১০০ দিনের কাজ 'বন্ধ' করার পরিকল্পনার প্রতিবাদে প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়াতে প্রতিবাদীদের। ১৭ ডিসেম্বরের সাংবাদিক সম্মেলন অন্যান্য অনেক সাংবাদিক সম্মেলনের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। কারণ, মঞ্চে উপস্থিত ব্যক্তিদের পেশাগত দুনিয়ায় ছিল ব্যতিক্রমী। একদিকে ছিলেন ভারতের দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের আইনি অধিকারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করা বিশিষ্ট উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক, জয়তী ঘোষ ও মহিলা আন্দোলনের নেত্রী অ্যানি রাজা। অন্যদিকে তাঁদের পাশেই বসেছিলেন সেই আইনটির সুবিধাভোগীরা- রাজস্থানের বেয়াওয়ার জেলার গ্রামীণ শ্রমিক কমলা দেবী ও শ্রাবণী দেবী।
এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মোদি সরকারের হাতে এমজিএনরেগা (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন) কার্যত ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।
২০০৫ সালে প্রণীত এমজিএনরেগা আইন গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জন্য বছরে অন্তত ১০০ দিনের মজুরি-সহ কাজের আইনি নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু বক্তাদের অভিযোগ, এই ঐতিহাসিক ও অধিকার আইনটিকে এখন সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে ‘VB-G-RAM-G’ (Viksit Bharat–Guarantee for Rozgar and Ajeevika Mission Gramin) নামে এক নতুন, অস্পষ্ট ও বিপজ্জনক বিল এনে।
বক্তারা জানান, এই নতুন বিল কেবলমাত্র গ্রামীণ মানুষের চাহিদাভিত্তিক কাজের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে না, বরং ১৯৯২ সালের ৭৩তম সংবিধান সংশোধনী আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চায়েতি রাজ ও গ্রামীণ গণতন্ত্রের ভিত্তিকেও দুর্বল করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে এটি আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘন করে কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে এবং আর্থিক বোঝা রাজ্যগুলোর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের উপর প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারির পথও খুলে দিচ্ছে এই বিল।
দ্যা ওয়্যার-এর প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রখ্যাত মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক এমজিএনরেগা কার্যত তুলে দেবার চেষ্টাকে ‘নিন্দনীয়’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি মনে করিয়ে দেন, “এমজিএনরেগা কোনও তড়িঘড়ি করা আইন ছিল না। দীর্ঘ আলোচনা ও গভীর চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়েই এটি তৈরি হয়েছিল এবং সংসদে সব রাজনৈতিক দলের সর্বসম্মত সমর্থনে পাশ হয়েছিল। তাই, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই এমন একটি আইন বাতিল করা যায় না।”
মহিলা আন্দোলনের নেত্রী অ্যানি রাজা বলেন, এমজিএনরেগা কেবল একটি সরকারি প্রকল্প নয় বরং এটি ছিল বহু মানুষের যৌথ সংগ্রামের ফল। “মহিলা, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক এবং নাগরিক সমাজ, সবার অবদানেই এই আইন বাস্তবায়িত হয়েছিল। আজ অনেকেই এই ইতিহাস জানেন না,” বলেন তিনি।
আইনটির মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির দিকটিও তুলে ধরেন রাজা। তিনি বলেন, “মহিলা সংগঠনগুলির জোরেই এমজিএনরেগায় শিশু যত্ন, ক্রেশ ও ডে-কেয়ারের ধারণা যুক্ত হয়েছিল। এমজিএনরেগার আগে পঞ্চায়েতগুলির বার্ষিক বাজেট পাঁচ-দশ হাজার টাকার বেশি হতো না। এই আইনের পর তা লক্ষাধিক টাকায় পৌঁছেছে।”
‘উন্নয়ন’ শব্দটির বাস্তব অর্থ কী, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এক গ্রামীণ বৃদ্ধার অভিজ্ঞতার কথা শোনান। “এক বৃদ্ধা আমাকে বলেছিলেন, এমজিএনরেগার টাকায় প্রথমবার তিনি নিজের নাতনির জন্য জামা কিনতে পেরেছেন। আগে একটি টিপ কেনার টাকাও তাঁর ছিল না। এই হল প্রকৃত উন্নয়ন।”
বেয়াওয়ার জেলার শ্রমিক কমলা দেবী নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “আমার পরিবারে আর কেউ রোজগার করে না। শুধু আমিই করি। এমজিএনরেগার মাধ্যমে বছরে ১০০ দিন কাজ পাই, যদিও অনেক সময় ৪০-৫০ দিনেই সীমাবদ্ধ থাকে। দৈনিক মজুরি ২৮১ টাকা। বছরে মোটে ২৮ হাজার টাকার মতো রোজগার হয়। কিন্তু এইটুকুও যদি সরকার কেড়ে নেয়, আমরা বাঁচব কী করে?”
VB-G-RAM-G বিলের ৬০ দিনের ‘নো-ওয়ার্ক ক্লজ’-এর তীব্র সমালোচনা করেন বক্তারা। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ বলেন, “কাজের আইনি নিশ্চয়তা মানে কাজ চাওয়া মাত্র তা পাওয়ার অধিকার। কিন্তু এই বিল নিজেই ৬০ দিন কাজ বন্ধ রাখার অনুমতি দিচ্ছে। এতে অধিকার একটি শর্তসাপেক্ষ কল্যাণ প্রকল্পে পরিণত হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সরকার মানুষের খাদ্য ও কাজের অধিকারকে সরকারের দয়া হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। ভবিষ্যতে এটি বৈষম্যের রাজনীতিতে ব্যবহার করা হবেই।”
এমজিএনরেগার অন্যতম রূপকার জঁ দ্রেজ বলেন, “যদি কোনও বিষয়ে ভারত সত্যিই বিশ্বগুরু হতে পারত, তা হলে তা এমজিএনরেগার মতো একটি প্রকল্প। কিন্তু আজ সেটিও ধ্বংসের মুখে।” তিনি VB-G-RAM-G বিলের ‘সুইচ-অফ ক্লজ’-কে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে আখ্যা দেন। “কেন্দ্র ঠিক করবে কোথায়, কবে এই প্রকল্প চলবে। এটা তো অনেকটা এই কথা বলার মতো যে, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, কিন্তু গ্যারান্টি চালু থাকবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।”
রাজ্যগুলোর জন্য বরাদ্দ কমিয়ে ৬০:৪০ ব্যয়ের প্রস্তাব নিয়েও তিনি সতর্ক করেন। “দরিদ্র রাজ্যগুলোর পক্ষে অতিরিক্ত বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। এটি কার্যত প্রকল্পটিকে মেরে ফেলবে। আমরা এই আইনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করব।”
শেষে রাজস্থানের এমজিএনরেগা শ্রমিক শ্রাবণী দেবী বলেন, “মোদি ভাবছেন, তিনি পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু দেশের কৃষক ও শ্রমিকরা তাঁকে দেখিয়ে দেবে এটা সম্ভব নয়। আমরা আগে জিতেছি। আবারও জিতব।”
এই সাংবাদিক সম্মেলন স্পষ্ট করে দিল এমজিএনরেগা কেবল একটি প্রকল্প নয়, এটি ভারতের গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের মর্যাদা ও অধিকারের প্রতীক। আর সেই অধিকারের উপর আঘাত এলে প্রতিরোধও অনিবার্য।
