অভিনেতা সন্তু মুখোপাধ্যায় যেমন জনপ্রিয়তাকে আমল দিতেন না, তাঁর স্ত্রী গোপা মুখোপাধ্যায়ও ছিলেন একই রকম। কোনও ভ্রুক্ষেপই থাকত না, নির্বিকার থাকতেন। সন্তু মুখোপাধ্যায় তাঁর সন্তানদের চিরকাল বলতেন, “স্টুডিওটাই আমার অফিস।” তাঁদের মেয়ে তথা জনপ্রিয় অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও ঠিক তেমন। বরাবর। আজও সেই ব্যাপারটির সামান্যতম হেরফের হয়নি। “সাধারণ জীবনযাপনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার”, এই ভাবনা থেকেই। এবং বাবা-মায়ের থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকেই। তাই তারকা হয়েও রিকশায় উঠে পড়তে পারেন যখন-তখন। এবং রিকশায় উঠেই গল্পে মেতে যাওয়া, আর সিনেমার বাইরে সাধারণ জীবনযাপনে নিজেকে গুছিয়ে রাখা”— এটাই স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের চেনা মুখ। বাবার মতোই বাস্তবের মাটিতে পা রেখে চলেন তিনি।রিকশাচালকের সঙ্গে দিব্বি গল্প করতে করতে পেরিয়ে যান পথ। তাঁর কথায়, ‘ডানা’ গজায়নি! তাই হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবে নিজের স্টারডম-কে অনায়াসে জানলা দিয়ে ফেলে দিতে পারেন। তাই হয়তো তাঁর মনে হয়, “রিল বানানোর এই দশ সেকেন্ডের দুনিয়ায় সবাই ফেমাস। মরলে ক’জন মনে রাখবে, ভাল কাজ কী রেখে যেতে পারব, অবলা বাচ্চাগুলোর জন্য কী করে যেতে পারলাম—তাতেই হয়তো বিচার হবে।” এক কথায় আর পাঁচজন টলিপাড়ার তারকার জীবনবোধে বিশ্বাসী নন স্বস্তিকা ,তাই তো অনায়াসে বলতে পারেন, " নিজের মতো বাঁচব, নিজের ভালো থাকাকেই গুরুত্ব দেব, বাকিটা? ধুর, ছাড় তো! "
জীবনবোধ, স্টারডম, পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় একটি নাতিদীর্ঘ পোস্ট করেছেন সমাজমাধ্যমে। লেখায় মাঝেমধ্যেই এসেছে তাঁর বোনের কথা-ও। সেই আটপৌরে লেখা পড়ে মনকেমন করে উঠেছে নেটপাড়ার। তাই তো, অধিকাংশ নেটিজেনরা অভিনেত্রীর উদ্দেশ্যে বলে উঠেছেন – “...এমন সহজ থাকুন, যদিও রবি ঠাকুর বলেছেন সহজ থাকায় সবচাইতে কঠিন কাজ!”
ফেসবুকে স্বস্তিকা লিখেছেন,
“আমাদের পরিবারের একটা দারুণ ব্যাপার হলো — আমাদের কাজের জায়গার বাগেজ নিয়ে আমাদের কারোর কোনোদিন কোনো মাথাব্যথা নেই।
বাবা চিরকাল বলত, “স্টুডিওটাই আমার অফিস।”
মা খুবই সাধারণ গৃহবধূর মতো জীবনযাপন করত, বড় ফিল্মস্টারের বউ বলে তেমন কিছুই পালটায়নি।
পরবর্তী কালে আমি আর বোন এই ইন্ডাস্ট্রিতেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করি বলে আমাদেরও আলাদা করে কোনো ডানা গজায়নি।
দশ–পনেরো বছর, বা তারও আগে,রাস্তাঘাটে মানুষ চিনতে পারলেই আমাদের জনপ্রিয়তা বিচার হতো।
ওদিকে যাদবপুর, যোধপুর পার্ক — এদিকে টলিগঞ্জ, করুণাময়ী দিকটায় যেতে হলে, সঙ্গে যদি বোন থাকত, অবধারিতভাবে বলত,
“চল চল, রিকশা করে যাই।”
আমি তখনই বলতাম, “একদম না, আমি রিকশা করে যেতে পারব না, ট্যাক্সি নেব।”
বোনের সেই একই উত্তর —
“কেন রে? তুই কে রে? কেউ চিনবে না। চল তো, বেশি বাড়াবাড়ি করিস না, খুব বড় হিরোইন হয়ে গেছিস যেন!”
আমি ব্যাগ দিয়ে মুখটা আধো ঢেকে রিকশা চেপেই ফিরতাম।

তারপর অল্প কিছুক্ষণ পরই রিকশাওয়ালা বলত,
“ও দিদি, তুমি বই কর না? তোমার এটা দেখেছি, সেটা দেখেছি… না না, পয়সা লাগবে না!” ইত্যাদি।
আমার বোনের কোনো ভ্রুক্ষেপই থাকত না, নির্বিকারভাবে রাস্তা দেখত।
সোশ্যাল মিডিয়ার আগে ও পরে পৃথিবীটাই পালটে গেছে।
তখন কেউ চিনতে পারলে কত কথা হতো — কোন সিনেমা কেমন লাগল, তাদের বাড়ির লোকদের কোন ছবি ভালো লেগেছে,
দেশের গ্রামের হলে কোন বই (ছবি) এসেছে, এই নিয়েই গল্প।
সিনেমার জগতের নক্ষত্ররা তখন যেন অধরা মাধুরী।
আর এখন,পরিচিতি আকাশছোঁয়া হলেও, ওই সেলফি তোলা ছাড়া আর কোনো কথা নেই।
সব নক্ষত্রই এখন হাতের মুঠোয়, ফোনের স্ক্রিনে বন্দি।
আর আমি এমনিতেই এই নিয়ে চ্যাদ -ভ্যাদ কমই করি — বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেটা আরও কমে যাচ্ছে।
রিল বানানোর এই দশ সেকেন্ডের দুনিয়ায় সবাই ফেমাস।
মরলে কজন মনে রাখবে, ভালো কাজ কী রেখে যেতে পারব, অবলা বাচ্চাগুলোর জন্যে কী করে যেতে পারলাম — তাতেই হয়তো বিচার হবে।
কোভিডের সময় থেকে আবার একটু করে ওই রিকশায় চড়া শুরু হলো।
আহারে, ওদের তো রোজগারই নেই, পাড়ার কুকুরছানাগুলোকে ওরাই দেখে রাখে,
সাধারণ জীবনযাপনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার, এসবই ভাবি মাঝে মাঝে।
লক্ষ্মীপূজোর দিন একটা নিমন্ত্রণে যাওয়ার ছিল, দশ–পনেরো মিনিট দূরে — রিকশা করেই গেলাম।
পরশু একটা কাজের জায়গায় যাওয়ার ছিল, বিজয়গড় থেকে একটু দূরে।
বোন বলল, “রিকশা নিয়েই যাই চল।”
আমি মুখের দিকে তাকাতেই হেসে বলল, “উবের নিবি নাকি?”
তোকে কেউ চিনবে না দিদি — এটা আর বলল না, এই অনেক ভাগ্যি!
রিকশা করেই গেলাম, ছোটবেলার মতো।
বোন তো আগেই কাঠির মতো রোগা হচ্ছে, যাক বাবা, আমিও হচ্ছি —
তাই দু’জনেই ফিট করে গেলাম
গপ্প করতে করতে টুকটুক করে চলে গেলাম।
পাড়ার রিকশাদাদার আবার নাতি–পুতিও আসছে, তাই বকশিসও পেল।
বোনের মুখের ডগায় যে কথাটা সবসময় ঝোলে, সেটা হলো
“ধুর, ছাড় তো!”
শুনতে শুনতে ওটাই যেন জীবনবোধ হয়ে দাঁড়িয়েছে —
নিজের মতো বাঁচব, নিজের ভালো থাকাকেই গুরুত্ব দেব,
বাকিটা? ধুর, ছাড় তো!”
(পোস্টের বানান অপরিবর্তিত রাখা হল)
