প্রয়াত হয়েছেন কিংবদন্তি অভিনেতা আসরানি। ৮৪ বছর বয়সে, দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর, গত সোমবার (২০ অক্টোবর, ২০২৫) দুপুর ১টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নিজের দীর্ঘ ফিল্ম কেরিয়ারে অসংখ্য চরিত্রে নিজেকে প্রমাণ করেছেন এই বর্ষীয়ান অভিনেতা। আসরানি ছিলেন ভারতীয় সিনেমার অন্যতম প্রিয় মুখ। এক অনবদ্য কৌতুকাভিনেতা, যিনি ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে ৩৫০টিরও বেশি ছবিতে হাসির রঙ ছড়িয়েছেন। পুনের এফটিআইআই -এর প্রাক্তন ছাত্র আসরানি ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি বলিউডে পা রাখেন। শুরুতে গুরুগম্ভীর চরিত্রে অভিনয় করলেও খুব তাড়াতাড়িই তাঁর অনবদ্য হাস্যরস ও কমিক টাইমিং তাঁকে বানিয়ে তোলে দর্শকদের প্রিয় মুখ। বিশেষত সাত ও আটের দশকে, তিনি ছিলেন প্রতিটি পরিবারের হাসির কারণ। একেক সময় গোঁড়া কেরানি, কখনও বা দিশেহারা সহকারী আবার কখনও সরল, বিভ্রান্ত প্রেমিকের চরিত্রে অবিস্মরণীয়। আজও তাঁর প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি হাসি বলিউডের এক সোনালি যুগের স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে তাই তো সিনেমা রসিকদের কথায়, “আসরানির প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি আর নিখুঁত টাইমিং যেন হয়ে উঠেছিল ভারতের হাস্যরস অভিনয়ের পাঠ্যবই।” কিংবদন্তি এই শিল্পীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া পড়েছে টলিপাড়াতেও। আসরানিকে নিয়ে আজকাল ডট ইন-এর সঙ্গে নিজেদের মনখারাপ থেকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন বাংলার দুই জনপ্রিয় অভিনেতা শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এবং খরাজ মুখোপাধ্যায় ।
শুভাশিস মুখোপাধ্যায় বললেন, “আসরানির অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে আমার নতুন করে বলার তেমন কিচ্ছু নেই। কারণ বহু বছর আগেই প্রমাণিত তিনি কত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন। বরং বলি, মানুষ আসরানির কথা। বহু বছর আগে ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। বুম্বা মানে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রযোজিত একটি ছবিতে আসরানিজির সঙ্গে কাজ করেছিলাম। সেই ছবিতে জয়া প্রদা, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় ছিল। র প্রায় পুরো শুটটাই হয়েছিল বাংলাদেশে। সেই সময়ে আসরানিকে প্রথম কাছ থেকে দেখা। ওঁর মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য দেখিনি কোনও তারকাসুলভ হাবভাব। বুঝতেই দিতেন না উনি এত বড় তারকা। খুব গপ্পে মানুষ ছিলেন, খোশমেজাজে থাকতেন। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন। মনে পড়ে না, কবে ওঁকে কাউকে ধমকাতে দেখেছি। সারাক্ষণ একটা মিষ্টি হাসি ওঁর মুখে লেগেই থাকত। তবে হ্যাঁ, একবার ক্যামেরা চালু হলেই সম্পূর্ণ সেই চরিত্রে ঢুকে যেতেন। দেখে মনেই হত না, মাত্র এক সেকেন্ড আগেও এই মানুষটি কত হাসাহাসি করছিলেন। শিখেছিলাম এটা। আর একটা কথা, আসরানিজির সন্ধ্যেবেলায় একটু মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। মনে আছে, মুম্বই থেকে এক স্যুটকেস ভর্তি মূল্যবান সব মদের বোতল সোজা করে নিয়ে এসেছিলেন। রোজ সন্ধ্যেবেলায় ওঁর ঘরে আসর বসত আমাদের। আমাদেরও ভাগ দিতেন সেই পানীয়র...” বলতে বলতে হেসে উঠলেন শুভাশিস।
“সেই ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকও কাজ করেছিলেন। আসরানি কী ভীষণ যে শ্রদ্ধা করতেন রঞ্জিতদাকে বললে বিশ্বাস করবেন না। তিনি অসম্ভব ভক্ত ছিলেন রঞ্জিতদার। আমরা তো অবাক হয়ে দেখতাম। আর একটা কথা বলতে চাই, আসরানি তো নানান চরিত্রে অভিনয় করেছেন সবক'টি দেখার মতো। তবে আমি একটু বলব, ‘শোলে’-র ওই ‘জেলর’ চরিত্রটির কথা। যেকোনও অভিনেতা স্বপ্ন দেখে আসরানিজির ওই চরিত্রটিতে অভিনয় করার কথা। কী ডেলিভারি, কী টাইমিং! এক দমে কথা বলা শেষ করেই ওরকম জোরে জোরে ‘হা-হা’ হাসি। কী টাইমিং। যে কোনও নতুন অভিনেতার কাছে অবশ্য শিক্ষণীয় এই চরিত্রে ওঁর অভিনয়। আর সিরিয়াস চরিত্রেও কী দারুণ অভিনয় করে গিয়েছেন উনি, যখন যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন। ‘অভিমান’-এর কথাই বলা যায় এখানে। আমার তো মনে হয়, একজন সিরিয়াস অভিনেতা না হলে ভাল কৌতুকাভিনেতা হওয়া যায় না। সিরিয়াসনেসটা থাকতে হবে, সংবরণটা থাকতে হবে অভিনয়ে, নইলে কমেডিটা ভাঁড়ামি হয়ে যাবে! আসরানির অভিনয় থেকে সেই সিরিয়াসনেসটা শেখা উচিত।”
আসরানির মৃত্যুসংবাদে স্তব্ধ খরাজ মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, “আক্ষরিক অর্থেই নক্ষত্রপতন। বিরাট, বিরাট বড় শূন্যস্থান। আসরানিজিকে নিয়ে আগে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা কিছু ভাগ করি। উনি যে বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, তার ডাবিং করেছিলাম আমি। ওঁর বাংলা উচ্চারণ যেহেতু খুব ভাল ছিল না, হিন্দি ঘেঁষাও ছিল তাই সেই ব্যাপারটি মাথায় রেখে সামান্য হিন্দি ঘেঁষা বাংলা উচ্চারণ করে কণ্ঠ দিয়েছিলাম ওঁর চরিত্রে। বড়-বড় সমালোচকেরা ভেবেছিলেন আসরানি-ই নিজে ডাব করেছিলেন, সে কথা লিখেওছিলেন। যাই হোক, বহু বছর পর আসরানিজির সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে দেখা। পরিচয় হওয়ার পর জানিয়েছিলাম, ওঁর সেই ছবিতে ডাবিং আমার ছিল। শোনামাত্রই আমার হাতটা চেপে ধরে বলেছিলেন, “আরে, দাদা আপনাকে তো অনেক খুঁজেছি আমি। ধন্যবাদ জনাব বলে। কী ভাল-ই যে ডাবিং করেছিলেন। চমৎকার!’ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ওঁর এই নম্রতা দেখে।”
“আরও একটা ব্যাপার বলা উচিত। বলিউডে বেশিরভাগ ছবিতে আসরানিকে আমরা কৌতুকাভিনেতা হিসেবেই অংকে পেয়েছি। কিন্তু এমন কিছু ছবিও পেয়েছিলাম, যেখানে স্পষ্ট বোঝা যায় কোন মাপের অভিনেতা ছিলেন আসরানি। কী ন্যাচারাল অভিনয়, উফ! আলো-ফ্রেম কিচ্ছুর পরোয়া করতেন না। অসাধারণ! আমাদের কাছে অভিনেতা হিসেবে উনি নমস্য। এই কথার জের টেনেই বলি...’অভিমান’-এর কথা তো অনেকেই জানেন। আমি আর একটি ছবির কথা বলব। ছয় অথবা সাতের দশকে একটি ছবি করেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, নাম ‘নির্দিষ্ট শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’। জীবনমুখী, অত্যন্ত সিরিয়াস ছবি। সেই ছবির হিন্দি ভার্সনে ভানুবাবুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসরানি। একটা দৃশ্য ছিল, বন্যায় পরিবার ভেসে গিয়েছে ওই কৌতুকশিল্পীর কিন্তু লোকজন বলছে তাঁকে, কৌতুকাভিনেতারা কেন কাঁদবে, দুঃখ পাবে? সে কথা শুনে হাসতে হাসতে কীভাবে কেঁদে ফেলেছিলেন আসরানি, দেখে গায়ে কাঁটা দেয় আজও। একেই বলে হয়ত জাত অভিনেতা! কুর্নিশ!”
পাঁচ দশকেরও বেশি দীর্ঘ কেরিয়ারে ৩৫০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন আসরানি। তাঁর অতুলনীয় কমিক টাইমিং আর অভিব্যক্তি তাঁকে করে তুলেছিল হিন্দি সিনেমার সেরা চরিত্রাভিনেতার মুখের একটিতে। ১৯৭৫ সালের কালজয়ী ছবি শোলে-তে তাঁর অভিনীত জেলারের চরিত্র আজও ভারতীয় পপ সংস্কৃতির অঙ্গ।
