মুক্তি পেয়েছে অনীক দত্তর নতুন ছবি ‘যত কাণ্ড কলকাতাতেই’। ছবি জুড়ে রয়েছে দু'টি সময়সারণি। একটি ১৯৬০-এর কলকাতার পরিবেশে, অন্যটি বর্তমান সময়ের। অনীক দত্তর ছবিতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে কলকাতা। তবে এবারে কলকাতা সবসময়ই স্রেফ রহস্যের পটভূমি নয়, বরং বলা যেতে পারে একটি জীবন্ত চরিত্র। যত কাণ্ড কলকাতাতেই ছবিতে তিনি তাঁর প্রিয় শহরকে ছবির সব থেকে প্রধান চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন।
ফেলুদার জায়গায় এবার গল্পের কেন্দ্রবিন্দু হল সাবা, বাংলাদেশের ঢাকার এক তরুণী যিনি নিজের পরিবারের শিকড় খুঁজতে পদ্মাপাড় থেকে হাজির হয়েছেন গঙ্গার পাড়ের শহরে । সেই খানাতল্লাশির মাঝেই সাবার হাতে আসে একটি ধাঁধা— “গোরাদের গোরস্থানের নিকট অবস্থান/ ফিরিঙ্গি দেবালয়ে/ সন্ত যোহান/ থমাস-নাম অঙ্কিত... চতুষ্কোনে বাঁধা/ ইষ্টিনামে পত্র আছে, সাঙ্গ হল ধাঁধা।”
সেই ধাঁধার সমাধানে সাবার পাশে এগিয়ে আসেন 'তোপসে' অর্থাৎ আবির চট্টোপাধ্যায়। ধাঁধার সূত্র উঠে আসে ‘ট্রিংকা’জ-এ এমন অ্যাংলো গায়িকা, সেন্ট জনস চার্চের কবরস্থান, পুরনো সাদা-কালো ফটো, নামী পেন্টারের আর্টওয়ার্ক, অনলাইন পোস্ট, কার্শিয়ং এবং ‘দুষ্টু লোক’— সব মিলিয়ে যাকে বলে, ফেলুদার ক্লাসিক গ্রামারের উপর একটি মজার আধুনিক টুইস্ট নিজস্ব ছন্দে বসিয়েছেন অনীক।
ছবির সংলাপগুলো তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত, এবং ফেলুদার ছন্দকে মনে করিয়ে দেয় স্পষ্টভাবেই। ছবির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মজার সংলাপ, রহস্য ও পুরনো কলকাতার নস্টালজিয়া একত্রে দর্শককে পুরো সময় ধরে পর্দার সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। যাঁরা ফেলুদার গল্পে বড় হয়েছেন, তাঁদের জন্য এগুলো যেন ছোট ছোট ‘ইস্টার এগস’। আর যাঁরা নতুন, খুব বেশি ফেলুদার গল্প পড়েননি তাঁদের চোখে এই ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলো অচেনা লাগলেও কলকাতার নিজস্ব রহস্যের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিগ্স পাজলের টুকরো হিসেবে পুরোপুরি কাজ করবে। অনীক দত্ত শহরের এই জীবন্ত চরিত্রকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছেন, যেখানে দর্শক শহরের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি রাস্তায় হারিয়ে যেতে পারে।
ছবির সাসপেন্স যথেষ্ট আকর্ষক। গতিবেগও মন্দ নয়। তবে হ্যাঁ, যদিও কিছু অংশ টেস্ট ক্রিকেটের ইনিংস মনে হলেও ছবির সৌন্দর্য, নস্ট্যালজিয়া এবং ফেলুদার ছোঁয়া সেই ধীর গতি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ঢেকে দেয়। এক কথায়, অনীক দত্তের পরিচালিত এই ছবি সত্যজিৎ রায়, ফেলুদার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা নিবেদন করে, তেমন শহরের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনের গল্পও তুলে ধরে। অবির চট্টোপাধ্যায় তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার মাধ্যমে যথাসাধ্য তোপসে-কে জীবন্ত করেছেন। যোগ্য সঙ্গত দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কাজী নওশাবা আহমেদ। তবে স্বল্প সময়ে স্পটলাইট কেড়েছেন দুলাল লাহিড়ী এবং অনিন্দ্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং কলকাতার পুরনো পরিবেশকে জীবন্ত করতে সিনেমাটোগ্রাফি এবং সঙ্গীতের ব্যবহার যেভাবে করা হয়েছে তা প্রশংসনীয়। এবং এই ফাঁকে জানিয়ে দেওয়া ভাল, 'সাবা'র চরিত্রটির ডাবিং কিন্তু করেছেন রোজা পারমিতা দে, এবং তা এতটাই শ্রুতিমধুর ও বিশ্বাসযোগ্য যে মনেই হয়নি কাজী নওশাবা আজাদ তা করেননি! রোজা নিজেও অবশ্য এ ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালক নিজেও 'যত কাণ্ড কলকাতাতেই'-এর একাধিক চরিত্রের সংলাপ ডাবিং করেছেন এবং বলাই বাহুল্য তা চমৎকারভাবে উতরেছে।
যদি আপনি পুরনো কলকাতার পরিবেশ, রহস্য গল্প এবং হাল্লাবিহীন বুদ্ধিদীপ্ত ছবির আগ্রহী হন, তবে 'যত কাণ্ড কলকাতাতেই' আপনার জন্যই। এটি শুধুমাত্র একটি টানটান গোয়েন্দা গল্প নয়; বরং শহরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি চমৎকার চিত্রায়ন। এককথায়, পুরনো বাংলা ছবি দেখার মজা এবং অভিজ্ঞতা তা যেন এই ছবির মাধ্যমেই নিপুণভাবে ফিরিয়ে এনেছেন পরিচালক।
তাহলে আর কি, দেখে আসুন –“গোরাদের গোরস্থানের নিকট অবস্থান/ ফিরিঙ্গি দেবালয়ে/ সন্ত যোহান/ থমাস-নাম অঙ্কিত... চতুষ্কোনে বাঁধা/ ইষ্টিনামে পত্র আছে, সাঙ্গ হল ধাঁধা”র সমাধান কী হল শেষমেশ!
