আলোর উৎসবের দিন আচমকা বলিউডে নেমে এল তীব্র শোকের ছায়া। প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা আসরানি। ৮৪ বছর বয়সে, দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর, সোমবার (২০ অক্টোবর, ২০২৫) দুপুর ১টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বর্ষীয়ান শিল্পীর মৃত্যুর খবরে সিলমোহর দিয়েছেন তাঁর ভাইপো অশোক আসরানি। কয়েকদিন ধরেই বুকে ব্যথার কারণে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন অভিনেতা। আসরানির আপ্ত সহায়ক  বাবু ভাইয়ের কথায়, “চার দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল আসরানিজিকে। তাঁর ফুসফুসে জল জমেছিল। টানা চার দিনের চিকিৎসার পর আজ দুপুরে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।” তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মুম্বইয়ের সান্তাক্রুজের শান্তিনগর শ্মশানে আজ সন্ধ্যাতেই সম্পন্ন হয়েছে তাঁর শেষকৃত্য। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেই ইনস্টাগ্রামে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন তিনি, যা এখন হয়ে উঠেছে তাঁর শেষ বার্তা।


যখন এক কিংবদন্তির জীবনের পর্দা নামে, তখন রয়ে যায় না শুধু তাঁর কাজের ভাণ্ডার। রয়ে যায় তাঁর প্রভাবের প্রতিধ্বনি। ৮৪ বছর বয়সে প্রয়াত বর্ষীয়ান অভিনেতা গোবর্ধন আসরানি ছিলেন শুধু এক কমেডি আইকন নয়, ছিলেন এক জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে তাঁর সূক্ষ্ম হাস্যরস, প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি আর নিখুঁত টাইমিং যেন হয়ে উঠেছিল ভারতের হাস্যরস অভিনয়ের পাঠ্যবই। জনি লিভার থেকে শুরু করে জাভেদ জাফরি, রাজপাল যাদব থেকে বরুণ শর্মা -সব প্রজন্মের কৌতুক অভিনেতাদের সৃষ্টিশীল জিনে মিশে আছে আসরানির ছাপ।

যে যুগে কমেডি মানেই ছিল উচ্চস্বরে নাটুকেপনা, সেই সময়ে আসরানি এনে দিয়েছিলেন সংযম, শালীনতা আর অভিনয়ের বুদ্ধিদীপ্ত ছন্দ। তিনি দেখিয়েছিলেন হাস্যরস মানে শুধুই চেঁচামেচি নয়, বরং ছন্দ, বুদ্ধি আর মানবিকতার মিশ্রণ। ‘শোলে’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘আজ কি তাজা খবর’, ‘গোলমাল’ আর ‘ছোটিসি বাত’-এ তাঁর অভিনয় প্রমাণ করে হাসানো মানেই হালকাভাব নয়, সেটাও এক গভীর শিল্প।

জনি লিভার একাধিকবার বলেছেন, “মেহমুদজি আর আসরানিজি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে কমেডির শক্তিকে ব্যবহার করতে হয়।” তাঁর মিমিক্রি, তৎক্ষণাৎ সংলাপ তৈরি আর মুখের অভিব্যক্তির খেলা সবই এসেছে আসরানির পথ দেখানো ঐতিহ্য থেকে, যেখানে হাস্যরস ছিল শিল্প, কোনও একঘেয়ে ফাঁকা বুলি আওড়ানো নয়। অভিনেতা জাভেদ জাফরির কথায়, “আসরানির সময়েই কমেডি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পায়।” হাস্যরসের ভেতরে আবেগের ভারসাম্য রাখার কৌশল এনে দিয়েছিলেন তিনিই।

শুধু সিনেমা নয়, টেলিভিশন আর মঞ্চনাট্যেও তাঁর প্রভাব গভীর। আজকের বহু স্ট্যান্ড-আপ শিল্পী বা মিমিক্রি পারফর্মারদের প্রেরণার উৎস সেই আসরানি। তাঁর চরিত্রগুলো ছিল আমাদেরই প্রতিবিম্ব। সাধারণ মানুষ, সমাজ বা ক্ষমতার অদ্ভুত খেলায় আটকে থাকা; সেই বাস্তবতাই আজকের ভারতীয় স্ট্যান্ড-আপ কমেডির মাটিকে করেছে উর্বর।

জীবনের শেষ পর্বেও তিনি নিজেকে নবীন করে তুলেছিলেন। বয়স্ক চরিত্রেও বজায় রেখেছিলেন সেই অদম্য স্ফুলিঙ্গ, যা একসময় দর্শকদের হেসে কুটিকুটি করত। সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলে নিয়ে আসরানি প্রমাণ করেছিলেন সত্যিকারের কৌতুক অভিনেতা কখনও বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েন না; তারা কেবল হাসির নতুন রূপ খুঁজে নেন। হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে আসরানি যেন এক সেতুবন্ধন। মেহমুদের স্বর্ণযুগ আর জনি লিভারের আধুনিক হাস্যবোধের মধ্যে সংযোগরেখা। তাঁর উত্তরাধিকার শুধু সংলাপে নয়, বরং সেই আত্মবিশ্বাসে, যা তিনি দিয়েছিলেন হাস্যরসকে, যে হাসিও হতে পারে মর্যাদাপূর্ণ, বুদ্ধিদীপ্ত আর চিরন্তন।

 

পাঁচ দশকেরও বেশি দীর্ঘ অভিনয়জীবনে প্রায় ৩৫০টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন আসরানি। হাস্যরসের জাদু আর নিখুঁত টাইমিং দিয়ে তিনি ছুঁয়ে গিয়েছেন কোটি দর্শকের হৃদয়। ‘শোলে’-তে জেলারের ভূমিকায় তাঁর সংলাপ, “হাম ইংরেজোঁ কে জামানে কে জেলর হ্যায়” আজও অমর। ‘চুপকে চুপকে’, ‘আজ কি তাজা খবর’, ‘বাওয়ারচি’, ‘কোশিশ’-এর মতো ছবিতেও তিনি ছিলেন অনবদ্য।