আরব সাগরের তীরে ‘স্বপ্নের নগরী’ মুম্বই—যেখানে প্রতিদিন হাজারো স্বপ্ন এসে জমা পড়ে। কেউ পৌঁছে যায় আকাশছোঁয়া তারকার মিছিলে, কেউ আবার হেরে গিয়ে হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। আর এমনই এক চরম অবহেলা, প্রত্যাখ্যান আর 'অযোগ্য' তকমা পেরিয়ে উঠে আসার গল্প হল শিল্পা শিরোদকরের।
মারাঠি চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী মীনাক্ষী শিরোদকরের নাতনি, প্রাক্তন মিস ইন্ডিয়া নম্রতা শিরোদকরের দিদি—এই শক্তিশালী পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা সত্ত্বেও, বলিউড তাঁকে ‘মোটা’, ‘আকর্ষণহীন’ আর ‘অপয়া’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আরও ভাল করে বললে, ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল! এমনকী তাঁর প্রথম ছবি হওয়ার কথা ছিল বনি কাপুরের প্রযোজনায়, সঞ্জয় কাপুরের বিপরীতে। কিন্তু শুটিং শুরুর আগেই সেই ছবির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর তাঁর আরও দু’টি ছবি মুখ থুবড়ে পড়ে, আর ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা শিল্পার গায়ে সেঁটে দেন ‘অপয়া’ তকমা। কেউ আর কাজ দিতে চাইছিলেন না। সেই অন্ধকার সময়েই আলোর মতন সামনে এলেন একজন মানুষ—মিঠুন চক্রবর্তী।
‘দাদা’র ছায়ায় অভিনেত্রী হিসেবে দ্বিতীয় জন্ম হয়েছিল শিল্পার। এক সাক্ষাৎকারে শিল্পা জানান, সেই সময় মাধুরী দীক্ষিতের ম্যানেজার ঋকু নাথ তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে। এরপর কলকাতার এক ধুমধামপূর্ণ ছবির মহরতে মিঠুন নিজে ঘোষণা করেন, নতুন ছবির নায়িকা হচ্ছেন শিল্পা শিরোদকর।এই ঘোষণাই তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই তাঁকে কাস্ট করা হয় রমেশ সিপ্পির ছবি ‘ভ্রষ্টাচার’-এ, যেখানে তিনি অভিনয় করেন একজন অন্ধ তরুণীর চরিত্রে, মিঠুনের বিপরীতে। এবং সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর আসল বলিউড সফর। শিল্পার কথায়, “আমি আজ যেখানেই দাঁড়িয়ে আছি, তার কৃতিত্ব মিঠুন দাদার। তিনিই আমায় সুযোগ করে দিয়েছিলেন।”
বলিউডের বড় তারকাদের মধ্যে যেমন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ‘হাম’ ও ‘খুদা গवाह’, গোবিন্দার সঙ্গে ‘আঁখে’ ও ‘প্রতীক্ষা’র মতো ছবিতে কাজ করেছেন শিল্পা। তবুও যেভাবে অনেক তারকা আকাশছোঁয়া খ্যাতি পান, তেমনটা কখনও আসেনি তাঁর ভাগ্যে। তবে তাতে কিছু যায় আসে না শিল্পার। বলিউড ছেড়ে একসময় তিনি নিজের জীবনে ফিরেছেন—বিয়ে করেছেন, লন্ডনে স্থায়ী হয়েছেন, সংসার করেছেন।
আজও যাঁরা এই ইন্ডাস্ট্রিকে স্বপ্নের দুনিয়া ভাবেন, তাঁদের জন্য শিল্পা শিরোদকরের জীবন একটা বড় রিয়্যালিটি চেক। শুধু প্রতিভা নয়, কখনও কখনও একটা হাত, একটা সুযোগ, একটা মানুষই বদলে দিতে পারে ভাগ্য। আর সে গল্পে মিঠুন চক্রবর্তী হয়ে উঠেছেন সেই আশ্চর্য ‘দাদা’—যিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একটা প্রত্যাখ্যাত মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই সাহস, সেই আস্থা আর শিল্পার নিরলস লড়াই—এই গল্পটাকেই করে তোলে সত্যিকারের অনুপ্রেরণা।

প্রসঙ্গত, গত ১৬ জুন মিঠুন চক্রবর্তীর ৭৫তম জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিযেছিলেন একসময় টলিপাড়ার জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার এন কে সলিল। তাঁর কথায়, “মিঠুনদার সঙ্গে টানা ১৬টা ছবিতে কাজ করেছি। ‘বারুদ’ থেকে শুরু, তারপর ‘যুদ্ধ’, ‘এমএলএ ফাটাকেষ্ট’, ‘হাঙ্গামা’…কত বলব! একসময় মিঠুন-এন কে সলিলের জুটি মানেই নিশ্চিন্তের শ্বাস ছাড়তেন প্রযোজকেরা, অন্যদিকে উত্তেজনায় ফুটতেন দর্শকেরা। মিঠুনদার সঙ্গে প্রথম আলাপে উনি শুধু আমাকে বলেছিলেন, ‘যেভাবে, যে ছন্দে হিন্দি ছবিতে আমি সংলাপ বলি, দর্শক যেভাবে আমাকে দেখে অভ্যস্ত ওরকম সংলাপ-ই বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে বলতে চাই। বাকিটা তুমি বুঝে নাও, কী করবে।’ ব্যাস! মিঠুনদাকে স্টাডি করার শুরু করলাম। ওঁর অভিনীত সব হিন্দি ছবি টানা দেখা থেকে ওঁর সঙ্গে মেলামেশা, ওঁকে কাছ থেকে দেখা। মিঠুনদা আমার লেখা সংলাপ খুব পছন্দ করতেন। আমিও চাইতাম, আমার লেখা সেরা সব সংলাপ যেন মিঠুনদার মুখ থেকেই ডেলিভারি হয়।”
কথাশেষে তাঁর সংযোজন, “একটা কথা বলি, মিঠুনদা যে বাংলা ছবিতে কাজ করতেন তখন, স্রেফ বাংলা ভাষাকে ভালবাসেন বলে। উনি বছরে তিনটি ছবি করলে এবং তা জনপ্রিয় হলে বহু মানুষের রোজগার হবে, তাই করতেন। বলিউডের এক নম্বর তারকা যখন ছিলেন, তখনও বাংলা ছবিতে অভিনয় করে গিয়েছেন। আজও মুম্বইয়ে মিঠুনদা মানে বিরাট নাম। কিন্তু ওঁর মন কিন্তু গেঁথে রয়েছে এই বাংলাতেই।”
