আজকাল ওয়েবডেস্ক: মহাকাব্য রামায়ণে বহু চর্চিত ১৪ বছর বনবাস পর্বে প্রভু রামচন্দ্র, স্ত্রী সীতা এবং ভাই লক্ষণকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল পঞ্চবটী বনের এক পর্ণ কুটিরে। পুরাণ মতে, গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটীর বনে যে পর্ণ কুটির নির্মাণ করে রাম-সীতা ও লক্ষণ বাস করত, সেখান থেকেই সীতাকে অপহরণ করেছিল রাবণ। 

আর আধুনিক যুগে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ-১ ব্লকে কানুপুর পঞ্চায়েতের পঞ্চবটী গ্রামে বহু বাসিন্দা এখন ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত ভোটার তালিকার বিশেষ সংশোধনে (এসআইআর)এবং এনআরসি-র আতঙ্কে।

 

কানুপুর পঞ্চায়েতে পঞ্চবটী গ্রাম কবে গড়ে উঠেছিল কেউ সঠিকভাবে বলতে না পারলেও অনেকেই দাবি করেন পাঁচ জায়গা থেকে লোক এসে এই গ্রাম গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম 'পঞ্চবটী'। এই গ্রামের অনেক বাসিন্দার পূর্বপুরুষ এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা ছিলেন বলে জানা যায়। দেশভাগ এবং একাত্তরের যুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু হয়ে তাঁরা মুর্শিদাবাদ জেলায় এসে এই গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। আজ তাদের মধ্যে অনেকের বংশধররাই এই গ্রামে থাকেন। 

 

আরও পড়ুন: মায়ের হাতের রান্নাতেই মৃত্যুফাঁদ! ভাত-ডাল খেয়ে পরপর তিন বোনের চরম পরিণতি, আঁতকে উঠল পুলিশও

 

সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের কিছু বাসিন্দার কাছে অসম সরকারের কাছ থেকে 'এনআরসি' নোটিশ এসে পৌঁছেছে। প্রায় একই সময়ে প্রতিবেশী বিহার রাজ্যে প্রায় ৬০ লক্ষ লোকের নাম বাদ গিয়েছে এসআইআর প্রস্তুতের সময়। মূলত মাছ ধরা এবং তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা পঞ্চবটী গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের একটাই প্রশ্ন, রাজ্যে বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধনী প্রক্রিয়া চালু হলে তাঁদের কি আদৌ আর ভারতের নাগরিকত্ব থাকবে? 

 

পঞ্চবটী এবং মীরের গ্রাম এলাকায় মোট ভোটার ১৩২৬ জন। ওই এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য প্রভাস হালদার বলেন, 'পঞ্চবটী গ্রামে মূলত হালদার, দাস এবং ঘোষ পদবীর পরিবারের লোকেদের বাস। তাঁরা মাছ ধরেন এবং মাছ বিক্রির কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।'

 

তিনি জানান, 'সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন ব্যক্তি এনআরসি-র নোটিস পাচ্ছেন। এর পাশাপাশি বিহারে 'এসআইআর' তৈরির সময় প্রচুর লোকের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে। সম্প্রতি বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে এই রাজ্যের বেশ কিছু বাসিন্দাকে 'বাংলাদেশি' সন্দেহে প্রতিবেশী দেশে 'পুশ ব্যাক' করে দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকেই এই গ্রামের বহু বাসিন্দা আতঙ্কে রয়েছেন। প্রচুর গ্রামবাসী ভয় পাচ্ছেন, আগামী দিন এই রাজ্যে এনআরসি বা বিশেষ সংশোধনী ভোটার তালিকা তৈরির কাজ শুরু হলে তাঁদের নিজেদের নাম না বাদ যায়। অনেকের আশঙ্কা আগামীদিনে হয়তো তাঁদের অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।' 

 

পঞ্চায়েত সদস্য আরও বলেন, '২০০০ সালে এই এলাকায় ভয়ানক বন্যা হয়েছিল। সেই সময় প্রচুর লোকের পুরনো নথি জলে ভেসে গিয়েছে। সেগুলো উদ্ধার করা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।' শ্রীরাম হালদার, জীবন হালদার সহ ওই গ্রামের বহু বাসিন্দা যদিও দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে নিজেদের এবং বাবার ভারতীয় হওয়ার প্রমাণপত্র রয়েছে। তবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাই তাঁদের দাদুরা বা তার আগের পূর্বপুরুষরা কোথায় জন্মেছিলেন বা কী করতেন তা মনে করতে পারছেন না। 

 

শ্রীরাম হালদার বলেন, 'আমার জন্ম এই গ্রামেই। একজন ব্যক্তির ভারতীয় নাগরিক হওয়ার জন্য যে যে প্রমাণপত্র দরকার যেমন -রেশন কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড তা সবই আমাদের রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি আমাদের দাদু-ঠাকুমার পুরনো নথি দেখতে চায় তা দেওয়া সম্ভব নয়। সেই কারণেই আমার মতো অনেক বাসিন্দা এখন চরম আতঙ্কে রয়েছি।'

 

কানুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান মেহের শেখ বলেন, 'পঞ্চবটী গ্রামের বাসিন্দারা কে কবে কোথা থেকে এসেছেন তা আমার জানা নেই। তবে ওই গ্রামের সমস্ত নাগরিকেরই ভারতীয় হওয়ার নথি রয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও কোনও মহল থেকে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ওই গ্রামের মানুষদের সমস্যা নিয়ে আজ আমরা বিশেষ বৈঠকে বসতে চলেছি।'

 

রঘুনাথগঞ্জ-১ ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি গৌতম ঘোষ বলেন, 'মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আজ আমরা 'ভাষা আন্দোলনে' নামছি। এর পাশাপাশি পঞ্চবটী গ্রামের মানুষদের বিরুদ্ধে যে গোপন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে আমরা তারও প্রতিবাদ করছি। বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার, নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে যে গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে তা আমরা সফল হতে দেব না। ওই গ্রামের সমস্ত মানুষদের পাশে তৃণমূল কংগ্রেস থাকবে।'