পল্লবী ঘোষ: ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ। পলাশীর যুদ্ধ। তার ঠিক কয়েক বছর আগেকার কথা। গোবরডাঙার জমিদার শ্যামলাল চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক উঠোনে শুরু হয় দুর্গাপুজো। সেই পুজোর আচার, রীতিনীতি এতটাই জাঁকজমকপূর্ণ ছিল, যে আশেপাশের বহু গ্রাম থেকে এসে ঠাকুর দালানে ভিড় জমাতেন সাধারণ মানুষ। দিন যত এগোয়, উৎসবের আমেজ, আনন্দ ক্রমেই বাড়তে থাকে। শ্যামলালের সময় পুজো শুরু হলেও, তাঁর পুত্র খেলারামের আমলে পুজোর আড়ম্বর কয়েকগুণ বেড়ে যায়। জানা যায়, প্রসন্নময়ী কালী মাতার আশীর্বাদে পুত্র সন্তান লাভ করেন তিনি। পুত্রের নাম রাখেন কালীপ্রসন্ন। এরপর থেকেই এই বংশের নবজাতকদের নামের সঙ্গে প্রসন্ন যোগ করার রীতি চালু হয়। গোবরডাঙা জমিদার বাড়ির দেবীকে প্রসন্নময়ী দুর্গাও বলতেন অনেকে। বাড়ির সদস্য নয়ন প্রসন্ন মুখার্জির কথায়, বর্তমানে জমিদারি না থাকলেও ৩১২ বছরের পুরনো পুজোর কিছু রীতি এখনও মেনে চলা হয়। জন্মাষ্টমীতে কাঠামো পুজোর মাধ্যমে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। বাবলা কাঠের কাঠামোয় তৈরি হয় প্রতিমা। প্রতিপদ থেকে শুরু ঘটপুজো। মহালয়ায় নয়, পঞ্চমীতে দেবীর চক্ষুদান করানো হয়। তারপর ষষ্ঠী থেকে শুরু চিরাচরিত পুজোর রীতি। এককালে বোধন আর সন্ধিপুজোর আগে কামান দাগার রীতি চালু ছিল। কামান দাগার শব্দ শুনে পুজোর দিনক্ষণ আন্দাজ করতেন দূরদূরান্তের মানুষ। বর্তমানে সেই প্রথা নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বলি প্রথাও উঠে গেছে। প্রসন্নময়ী দুর্গাকে ১৩টা পাঠা, ২ টো ভেড়া উৎসর্গ করা হত। ১৯৯৭ সাল থেকে পশুবলি প্রথা বন্ধ করে দেন বাড়ির সদস্যরা। দেবীর বিসর্জনের রীতিও ছিল চোখ ধাঁধানো। বাড়ির ১২টা পোষ্য হাতি নিয়ে বিসর্জনে বেরোতেন সদস্যরা। ভরা যমুনায় জোড়া নৌকা বেঁধে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হত। নয়ন প্রসন্ন মুখার্জি জানালেন, পুজোর ক'দিন জমিদার বাড়িতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসত। বাংলার প্রথিতযশা শিল্পীরা আসতেন সেখানে। এমনকী বিসর্জনের সময় যমুনায় নৌকাতেও গানবাজনার আসর বসত। তবে সেই রীতিরও পরিবর্তন হয়েছে। নয়ন প্রসন্ন মুখার্জি বললেন, জমিদার বাড়ির সকল সদস্যরা পুজোর কদিন এই বাড়িতেই কাটান। জৌলুস হারালেও, এখনও বোধন থেকে বিসর্জন অগণিত মানুষের ভিড় জমে বাড়িতে। ফলে দেবীর আরাধনার মাঝে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় গোবরডাঙা জমিদার বাড়ি। যার আলোয় আলোকিত হয় মফস্বলের অলিগলি।