আজকাল ওয়েবডেস্ক: নির্বাচন কমিশনের (ECI) বিশেষ নিবিড় সংশোধন (SIR) প্রক্রিয়া ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে তীব্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশন ১.৩৬ কোটি পশ্চিমবঙ্গের ভোটারের একটি তথাকথিত ‘লজিক্যালি ইনকনসিস্টেন্ট’ তালিকার সংখ্যা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বেছে নেওয়া কিছু ব্যক্তি ও গণমাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু সেই তালিকা আজও কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “১৬ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের দিনই কমিশন কীভাবে জানল যে ১.৩৬ কোটি ভোটারের ফর্মে যুক্তিগত অসঙ্গতি রয়েছে? এই তালিকা কোথায়? যদি তালিকা পরিষ্কার করাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কমিশন সেই তালিকা লুকিয়ে রাখছে কেন?” তিনি নির্বাচন কমিশনকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, অবিলম্বে এই তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হোক।
তিনি আরও বলেন, “একসময় বলা হয়েছিল বাংলায় নাকি এক কোটি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি রয়েছে। যদি তা সত্যি হয়, তাহলে অবৈধ অভিবাসীদের নামের তালিকাও প্রকাশ করা হোক।” অভিষেকের অভিযোগ, এসব দাবি আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভোটার তালিকা থেকে বৈধ নাগরিকদের বাদ দেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়ার অংশ।
তৃণমূল কংগ্রেসের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেল থেকেও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানানো হয়েছে। পোস্টে বলা হয়েছে, “জেলায় জেলায় মানুষ যারা শ্বাস নেয়, কাজ করে, ভোট দেয় তাদের কাগজে-কলমে মুছে ফেলা হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে নাগরিকদের ‘খুন’ করার দুঃসাহস দেখানো একটি কমিশনের বিরুদ্ধে কেন FIR হবে না?” পোস্টে আরও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, অবিলম্বে সম্পূর্ণ ও কথিত তালিকা প্রকাশ না করা হলে দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তর ঘেরাও করা হবে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বর তৃণমূল কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লিতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করবে। তাঁদের মূল দাবি ১.৩৬ কোটি ভোটারের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। সেই দাবি মানা না হলে রাজ্যজুড়ে ও জাতীয় স্তরে আন্দোলন শুরু হবে বলে তিনি সতর্ক করেন।
এদিকে রাজ্যের একটি সিভিল সার্ভিস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, নির্বাচনী রেজিস্ট্রেশন অফিসারদের (ERO) অজান্তেই ‘সিস্টেম-ড্রিভেন’ পদ্ধতিতে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে, যা আইনবিরুদ্ধ। এই প্রক্রিয়ায় কম্পিউটার অ্যাপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
অ্যাসোসিয়েশনটির বক্তব্য, আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার একমাত্র অধিকার ERO-র। তাছাড়া, কোনও ভোটারের নাম কাটার আগে তাকে যথেষ্ট নোটিশ দিতে হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কমিশনের এই ‘সিস্টেম-জেনারেটেড’ ডিলিশন প্রক্রিয়া শুধু আইনই নয়, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব নির্দেশিকারও লঙ্ঘন।
নির্বাচন কমিশনের দাবি করা ‘লজিক্যাল ইনকনসিস্টেন্সি’গুলিও মূলত সিস্টেমের তৈরি বলে অভিযোগ উঠেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে বানানগত ভুল, বয়স বা জন্মসালের অমিল ইত্যাদি। প্রথম ধাপে কমিশন ১.৩৬ কোটি ‘সন্দেহজনক’ ভোটারের মধ্যে ৩২ লক্ষকে ‘আনম্যাপড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে অর্থাৎ যাঁরা নিজেদের বা তাঁদের বাবা-মায়ের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় প্রমাণ করতে পারেননি। এই ২০০২ সালের তালিকাকেই ‘লিগ্যাসি বেস’ হিসেবে ধরা হয়েছে।
এই ‘আনম্যাপড’ ভোটারদের শুনানি শুরু হয় শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর। প্রথম দিন থেকেই উঠে এসেছে চরম হয়রানির ছবি। অনেক ভোটার অ্যাম্বুল্যান্সে করে শুনানিতে হাজির হন। মৎস্যজীবী ও দিনমজুররা অভিযোগ করেছেন, শুনানিতে যোগ দিতে গিয়ে তাঁদের দৈনিক রোজগার হারাতে হয়েছে।
ব্যক্তিগত স্তরে সমস্যার ছবিও সামনে এসেছে। ২৮ বছরের মনু মিত্রকে তাঁর বাবার ডেথ সার্টিফিকেট জমা দিতে বলা হয়েছে। যদিও তাঁর নিজের নাম ২০২৫ সালের খসড়া তালিকায় রয়েছে এবং তাঁর মায়ের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় ছিল। সমস্যা হয়েছে, কারণ তাঁর নথিতে তাঁর প্রয়াত বাবার নাম রয়েছে, যা ২০০২ সালের তালিকায় পাওয়া যায়নি। মনু জানান, তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছিল তাঁর জন্মের আগেই, বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন এবং তিনিই মায়ের কাছে মানুষ হয়েছেন।
একইরকম পরিস্থিতির শিকার কাদম্বিনী নস্কর। ২০২৫ সালের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে, কিন্তু ২০০২ সালের তালিকায় তাঁর নাম ছিল ‘কমলা নস্কর’। তাঁর ছেলে গুরুপদ নস্কর (৫২) বলেন, তাঁর মা ৭২ বছর বয়সি, শয্যাশায়ী এবং প্রায় ৫০ বছর ধরে ভোট দিয়ে আসছেন। ২০২৬ সালে তিনি ভোট দিতে পারবেন কি না, সেই আশঙ্কায় গুরুপদ নিজেই শুনানিতে এসে নথিপত্র জমা দেন।
বিধুভূষণ মণ্ডল (৬২) ও তাঁর স্ত্রী রেণুকা মণ্ডল (৫২)-এর নামও ২০২৫ সালের তালিকায় রয়েছে, কিন্তু তাঁদের ও তাঁদের বাবা-মায়ের নাম ২০০২ সালের তালিকায় না থাকায় তাঁদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তাঁদের বড় ছেলে তামিলনাড়ুতে কর্মরত; নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সে ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়েই উদ্বেগে পরিবারটি।
একজন ERO জানান, “অনেক ভোটারের বিভিন্ন নথিতে নামের বানান আলাদা। ২০০২ ও ২০২৫ সালের তালিকার মধ্যেও বানানগত পার্থক্য রয়েছে।” এর পাশাপাশি, কমিশনের ‘সিস্টেম’ এমন অদ্ভুত অসঙ্গতিও ধরেছে যেখানে বাবা ও ছেলের জন্ম সাল একই দেখানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাবা ও ছেলে, দু’জনকেই ১৯৮৫ সালে জন্মগ্রহণকারী দেখানো হয়েছে, যেখানে প্রকৃতপক্ষে ছেলের জন্ম ১৯৮৫ সালে এবং বাবার জন্ম ১৯৫৫ সালে।
এই বিপুল সংখ্যক ত্রুটি সংশোধনে নির্বাচন কমিশন বিপুল সময় ও সম্পদ ব্যয় করছে। কিন্তু ক্রমেই হয়রানির ঘটনা সামনে আসায় রাজ্যজুড়ে ক্ষোভ, উত্তেজনা ও অসন্তোষ বাড়ছে। পাশাপাশি, রাজ্য ও কেন্দ্রের প্রশাসনিক আধিকারিকদের মধ্যেও টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কি না এই প্রশ্নই এখন বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিসরে কেন্দ্রীয় বিতর্কে পরিণত হয়েছে।
