উদ্দালক
থিয়েটারের সমালোচনা আসলে কি শুধু নাটকটির সমালোচনা, নাকি থিয়েটার স্পেস নিয়েও আলোচনা। যে স্পেসের মধ্যে পড়েন দর্শক, অভিনেতা-সহ সকলেই। এই সামগ্রিকতার আলোচনা ততটা হয়নি, যতটা নাটকটি নিয়ে শুধু হয়েছে। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত সংসৃতির নতুন প্রযোজনা 'ফালতু' সেই আলোচনার পরিসর ও ভাবনাকে নতুন করে উস্কে দিয়ে গেল।
চোখের সামনে পড়ে থাকা অন্ধকার, আবছায়ায় আলো ফেলে দেখিয়ে দিয়ে গেল, এভাবেও কাজ করা সম্ভব। এভাবেও থিয়েটার হয়। আগেও হয়েছে, এখনও হয়, আলোচনা হলেও হয়, না হলেও হয়। তাই নাটকের আলোচনায় প্রবেশের আগে সংসৃতিকে আলাদা করে প্রশংসা করতে হয় বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরির মতো একটি জায়গায় এমন চমৎকার প্রযোজনা করার জন্য। থিয়েটারের আসল কথাটা, আঁতের কথাটা দর্শকের মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য। রোজকার মঞ্চ থিয়েটার প্রযোজনার বিপুল খরচ বৃদ্ধি, তারকাহীন থিয়েটারের প্রতি একাংশ দর্শকের অনিহা, সবকিছুর মধ্যে পড়ে যখন বাংলা থিয়েটার হাজার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন ভাষা খুঁজছে বাঁচার তাগিদে, তখন সংসৃতির মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ দলের এভাবে নেতৃত্বে থেকে অন্যতর স্পেসে থিয়েটারের পতাকা ওড়ানো নিঃসন্দেহে একটা ইতিহাস।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মূল গল্প অবলম্বনে এই নাটক নির্মাণ করেছে সংসৃতি। 'দেবী সর্পমস্তা' করার সময় কীভাবে পড়ে থাকা সেট থেকে আস্ত একটা নাটক ফেঁদে ফেলেছিলেন দেবেশ, সে গল্প অনেকেরই শোনা। এখানেও স্থানটিকে আমূল পাল্টে দিয়েছেন তিনি। বিজ্ঞান জানা থাকলে থিয়েটার যে কোনও স্থানে করা সম্ভব, সেটা আবারও প্রমাণ করেছেন তিনি।

নন-এসি, সাউন্ড প্যাডিং-হীন একটা হলকে নানাভাবে প্রচেষ্টা করে থিয়েট্রিক্যাল অভিজ্ঞতা দেওয়ার আশ্চর্য চেষ্টা করেছেন তিনি। দলের অভিনেতাদের নিয়ে তৈরি করেছেন এক ঘাটের দিনলিপি। মুহূর্তে উত্তর কলকাতার একটা ব্যস্ত এলাকার হলের ভিতরে তৈরি হয়েছে ঘাটের কথা। আর সেখানে ফিরে এসেছে জন্ম ও পরিচয়ের আদিম দ্বন্দ্ব। এক মোক্ষম সময়ে সংসৃতি এই নাটকটি বেছে নিয়েছে। যেখানে গোটা দেশজুড়ে মানুষেকে ভাগ করা হচ্ছে ভাষা, বর্ণ আর ধর্মের ভিত্তিতে, যেখানে একে-ওকে দেশছাড়া করার ভয় দেখানো হচ্ছে কোনও এককালে এই দেশে শরণার্থী হওয়ার দায়ে, তখনই এমন এক জীবনের গল্প নিয়ে তিনি কাজ করেছেন, যাঁর বৃহত্তম সংকট তাঁর পরিচয়। কে সে! কেন মানুষ হওয়ার পরেও প্রশ্ন ওঠে এসব নিয়ে, নাটক দর্শককে সেই প্রশ্নের প্রান্তরে এনে দাঁড় করায়। পরিচালক বলছিলেন, এখানে সর্বোচ্চ ২-৩ কিলোওয়াট আলো তিনি ব্যবহার করেছেন। থিয়েটারটিকে তিনি তৈরি করেছেন পোর্টেবল থিয়েটার হিসাবে। নাটক শেষে তিনি বলেন, 'যে কোনও জায়গায়, বাড়ির ছাদে, পাড়ার ক্লাবে এই থিয়েটার হতে পারে।' যেন, ফিরে আসে ফেলে আসা গ্রুপ থিয়েটারের সার কথা, যেন ফিরে আসছে বাতাস বয়ে।
নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনজন। অভ্র, কিঞ্জল, ত্রিহান। যাঁরা নাটকটি দেখে ফেলেছেন, তাঁরা এক ঝটকায় ভাবতে পারেন, দু'জন নয় তো! না, তিনজন, একবার তলিয়ে ভেবে দেখুন, তিনজনই। ত্রিহান, এই বয়সেও চমকে দিয়েছে। আর নাটকের তার বেঁধে রেখেছেন অভ্র। তিনি এই নৌকার কাণ্ডারি। অনবদ্য অভিনয় করেছে কিঞ্জল। তাঁকে ছোট-বড় পর্দায় অভিনয়ে দেখেছি আমরা, থিয়েটারের মঞ্চে তাঁকে নতুন ভাবে আবিস্কার করেছি। ময়রা বুড়ি, চৌবে জি, শম্ভু মাঝি, মদন ও ইসমাইল চরিত্রে সকলেই এক তারে অভিনয় করেছেন, নাটকের মেজাজ ধরে রেখেছেন আগাগোড়া।
নাটকের আবহ পরিকল্পনা করেছেন অনিন্দ্য নন্দী, আলোর দায়িত্বে ছিলেন সুজিত দাস, রূপসজ্জায় মহম্মদ আলি ও সংঘমিত্রা সরকার। তাঁরা সকলেই নতুন রকমের এক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে শুধু নয়, ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করেছেন। একেবারে নতুন স্পেস, নতুন দর্শকের দূরত্ব, নতুন সবকিছু, এই গোটা কাঠামোয় তাঁরা সাহস নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন, করতে পেরেছেন। অবশ্য সামগ্রিক পরিকল্পনাটিকে এক তারে বাঁধার জন্য নির্দেশক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়কে আবারও সাধুবাদ জানাতেই হয়।
নাটকের মঞ্চ আসলে নাট্যশিল্পীকে কী ফেরত দেয়, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিছু দিক না দিক, শেষ পর্যন্ত একটা তাগিদ দেয়। সেই তাগিদ অনেকটা লটারির লোভের মতো। সামান্য উপহার আরও বড় কোনও উপহারের দিকে ঠেলে দেয়। ঝুঁকি জেনেও সে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আবার নতুন করে কোনও এক ঐশ্বরিক মুহূর্তের জন্য, যেখানে সে দেখতে পায় নিজেকে। জেলা থেকে থিয়েটার শুরু করে আজও কলকাতার বড় মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ান অভিনেতা, নির্দেশক দেবেশ। তবু তিনি নাটক শেষে রিডিং লাইব্রেরির বাইরে দাঁড়িয়ে আগত দর্শকদের যখন বলেন, 'আপনারা চা খেয়ে যাবেন', তখন আমরা বোধহয় পৌঁছে যাই কঙ্কালীতলার বাউল আখড়ায়। শুক্লা পঞ্চমীর রাতে যেখানে সাধক বাউল বলেছিলেন, 'গান শুনে সেবা নিয়ে যাবেন কিন্তু!'
আমি জানি না, সব শিল্পীই চর্চার তুরীয় মার্গে বাউল হয়ে যান কি না। তবে দর্শক হিসাবে মাঝে-মাঝে এই বাক্যবন্ধে 'হ্যাঁ' বলতে ইচ্ছা করে, এবং সে ইচ্ছা সদর্থক।
