আজকাল ওয়েবডেস্ক: গর্ভাবস্থা এমন একটি সময় যখন মায়ের শরীরের প্রতিটি অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা সরাসরি গর্ভের শিশুর বিকাশে প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল অ্যালকোহল সেবন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল সেবন শিশুর মস্তিষ্কের রাসায়নিক গঠন ও কার্যপ্রণালীতে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এর ফলে শিশুর মানসিক, বুদ্ধি ও আচরণগত বিকাশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে।
অ্যালকোহল একটি নিউরোটক্সিন অর্থাৎ এটি স্নায়ুতন্ত্রের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গর্ভবতী মহিলা যখন অ্যালকোহল সেবন করেন, তখন সেই অ্যালকোহল সহজেই প্লাসেন্টা অতিক্রম করে শিশুর রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে। যেহেতু ভ্রূণের লিভার তখন সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয় না, তাই তার শরীর অ্যালকোহলকে ভাঙতে পারে না। এর ফলে অ্যালকোহল দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রূণের দেহে থেকে যায় এবং সরাসরি মস্তিষ্কের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে অ্যালকোহল মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। নিউরোট্রান্সমিটার হল সেই রাসায়নিক পদার্থ যা স্নায়ু কোষগুলির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। অ্যালকোহলের প্রভাবে এই রাসায়নিক সিগন্যালের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। এর ফলে, মস্তিষ্কের কোষগুলি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফল, শিশুর শেখার ক্ষমতা, মনোযোগের স্থায়িত্ব ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল সেবনের কারণে শিশুর মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস (যা স্মৃতি ও শেখার সঙ্গে যুক্ত) এবং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে) অংশে কোষের গঠন ও সংযোগে ত্রুটি দেখা দেয়। এর ফলে এমন শিশুদের মধ্যে পরবর্তীকালে মনোযোগ ঘাটতি (ADHD), শেখার সমস্যা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা এবং সামাজিক আচরণে অসামঞ্জস্য দেখা যায়।
আরও পড়ুন: হ্যালোইনের ভূতে কলকাতা কাঁপে! বিদেশি হুল্লোড় শিশুমনের আলো না আঁধার?
এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় Fetal Alcohol Spectrum Disorders (FASD)। এটি এক ধরনের বিকাশগত সমস্যা যা হালকা থেকে গুরুতর পর্যায়ে হতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে শিশুর মুখমণ্ডল বিকৃত হতে পারে, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মস্তিষ্কের কাঠামোগত বিকলতা দেখা দেয়। কিন্তু এমনকি অল্প মাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণও মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রাসায়নিক ভারসাম্যে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। যা ভবিষ্যতে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ও আচরণে প্রতিফলিত হয়।
অনেকে মনে করেন, মাঝে মাঝে এক গ্লাস ওয়াইন বা বিয়ার খেলে কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু চিকিৎসকরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, গর্ভাবস্থায় ‘নিরাপদ’ মাত্রার অ্যালকোহল বলে কিছু নেই। প্রতিটি গর্ভধারণ ভিন্ন, এবং অ্যালকোহলের প্রভাব নির্ভর করে অনেক উপাদানের ওপর, যেমন মায়ের বিপাকের গতি, শিশুর বিকাশের স্তর, এবং অ্যালকোহলের ধরণ। তাই গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল পুরোপুরি পরিহার করাই একমাত্র নিরাপদ উপায়।
মায়ের সামান্য অসতর্কতা শিশুর সারা জীবনের বিকাশ ব্যাহত করতে পারে, এটাই বাস্তব। তাই সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি যে, গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল সেবন কোনও ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
