এবনও শারীরিক অসুস্থতা। আচমকা কয়েক দিন আগে বাড়িতে টিভি দেখতে দেখতে অস্বস্তিবোধ করেন অভিনেত্রী সায়ন্তনী মল্লিক। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জানা যায় ব্রেক স্ট্রোকে আক্রান্ত তিনি। আপাতত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন অভিনেত্রী। সম্প্রতি মাইল্ড ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলও। শুধু সায়ন্তনী কিংবা অগ্নিমিত্রা নন, শরীরে তেমন কোনও সমস্যা না থাকলেও আচমকা ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আজকাল আকছার শোনা যায়। কয়েক বছর আগেও সাধারণত বয়স ৬০-এর কাছাকাছি না পৌঁছলে ব্রেন স্ট্রোকের প্রকোপ খুব একটা দেখা যেত না। এখন কমবয়সিদের জন্যও প্রাণঘাতীও হয়ে উঠছে এই অসুখ৷ কীভাবে এই রোগ থেকে দূরে থাকবেন? বিস্তারিত জানালেন রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের কনস্যালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট তথা বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্সর প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ডাঃ গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়।  


ঠিক কী এই অসুখ


সাধারণত দু’ধরনের স্ট্রোক হতে পারে। মস্তিষ্কের কোনও অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে বা বন্ধ হয়ে গেলে ইস্কেমিক স্ট্রোক এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে হ্যামারেজ স্ট্রোক। যে ধরনের স্ট্রোকই হোক না কেন, মারণ রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার অন্যতম দাওয়াই হল সঠিক সময়ে লক্ষণ শনাক্ত করে চিকিৎসা করা। 


কেন বাড়ছে স্ট্রোকের প্রকোপ 

•    এমনিতেই হাই প্রেশার প্রেশার, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল বেশি থাকলে কিংবা হার্টের সমস্যায় ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ইদানীং অল্প বয়সেই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে এই সব ক্রনিক রোগ বাড়ার প্রবণতা বাড়ছে। 


•    কমবয়সিদের অনিয়ন্ত্রিত ধূমপান, মদ্যপান, নানা রকম মাদকের নেশা ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

•    ওজন বেশি থাকলে ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।

•    স্বাস্থ্যকর খাবারের বদলে বেশি ফাস্ট ফুড খাওয়া ব্রেন স্ট্রোকের কারণ। 

•    তরুণ-তরুণীদের শরীরে কোনও অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে তা অবহেলা করার প্রবণতা রয়েছে। নিজের প্রতি সচেতনতার অভাব স্ট্রোকের বিপদ ডেকে আনছে।

•    শরীরে কোনও প্রদাহ বা ইনফেকশন থেকেও স্ট্রোক হতে পারে।

•    ছোট বয়স থেকে দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ অল্প বয়সে স্ট্রোকের অন্যতম কারণ।

•    জিনগত কারণেও কমবয়সিদের মধ্যে হতে পারে স্ট্রোক।


•    গর্ভনিরোধক কিংবা হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখার ওষুধ খেলে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা থাকে।

•    কাজের চাপে হোক কিংবা অলসতায় কমবয়সিদের মধ্যে ‘বডি মুভমেন্ট’ কমে গিয়েছে। যা অল্প বয়সে স্ট্রোক ডেকে আনছে। 

•    যার প্রচন্ড নাক ডাকেন অর্থাৎ যাঁদের অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ আপনিয়া রয়েছে তাঁদের স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে।

•    পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

•    শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি কিংবা অপুষ্টির কারণে স্ট্রোক হতে পারে।


লক্ষণ চেনাবে ছয় অক্ষর

স্ট্রোকের লক্ষণ চেনা অত্যন্ত জরুরি। কারণ লক্ষণ দেখে যতক্ষণে চিকিৎসা শুরু করা হবে তার উপরই নির্ভর করে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা। রোগী তো বটেই, সঙ্গে তাঁর আশেপাশের মানুষদের স্ট্রোকের লক্ষণ বুঝতে হবে। প্রথমেই যে সব লক্ষণ দেখে সাবধানতা নেওয়া প্রয়োজন তা বোঝার জন্য ৬টি ইংরেজি অক্ষরকে পাশাপাশি বসিয়ে শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে। যা হল ‘বি’, ‘ই’, ‘এফ’, ‘এ’, ‘এস’ এবং ‘টি’। একসঙ্গে বললে হয় ‘বি ফাস্ট’। যার বাংলা মানে দাঁড়ায় ‘দ্রুত করো’। আর এই ছয়টি অক্ষরের অর্থ জানা জরুরি। 


*বি মানে ভারমাস্যঃ অর্থাৎ হঠাৎ যদি কেউ শরীরের ভারমাস্য হারিয়ে ফেলেন তাহলে স্ট্রোকের কথা মাথায় রাখতে হবে। 

*ই মানে দৃষ্টিশক্তিঃ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে চোখে একসঙ্গে দুটো জিনিস দেখতে পান কিংবা চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। 

*এফ মানে ফেসঃ যাঁর স্ট্রোক হচ্ছে, তাঁর মুখ বেঁকে যায়। মুখের একটি অংশ ঝুলে যেতে পারে,মুখের কোনও এক দিক স্থির থাকে।   

*এ মানে আর্মঃ শরীরে একদিকের হাত অসাড় লাগা, হাতে জোর হারিয়ে যাওয়া, হাতের মতো পা নড়াচড়া করতে না পারা স্ট্রোকের সম্ভাব্য লক্ষণ। 

*এস মানে স্পিচঃ স্ট্রোক হলে কথা জড়িয়ে যায়। সঠিক শব্দ বেছে কথা বলতে অসুবিধা হয়। 

*টি মানে টাইমঃ উপরের যে কোনও একটি লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সঠিক সময়ের মধ্যে স্ট্রোক চিহ্নিত করে চিকিৎসা শুরু করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

অন্যান্য উপসর্গ 

হঠাৎ তীব্র মাথাযন্ত্রণা তবে সাধারণ যন্ত্রণা নয়, মনে হতে পারে যেন মাথা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ে যন্ত্রণা, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া প্রাথমিক স্তরের স্ট্রোকের এই লক্ষণগুলোও দেখা দিতে পারে। 


স্ট্রোক মানেই মৃত্যু নয়

ব্রেন স্ট্রোক মানে মৃত্যু, একেবারে ভ্রান্ত ধারণা। যার জন্য একেবারে গোড়ায় রোগ নির্ণয় করা জরুরি। স্ট্রোক হওয়ার প্রথম ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি সিটি স্ক্যান করে রক্ত শনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। পরীক্ষায় যদি মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধা ধরা পড়ে তাহলে বর্তমান উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীকে সুস্থ করে ফেলা সম্ভব। বর্তমানে থ্রম্বোলাইসিস বা থ্রম্বেক্টমি করে যে রক্তনালী রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে তা খুলে দিলে স্নায়ুকোষে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক হয়। রক্ত তরল করার ওষুধ দিলেও রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করা যায়। ফলে রোগীর সুস্থতার সম্ভবনা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেওয়া যায়। আগে সাড়ে ৪ ঘণ্টার পর্যন্ত এই ‘গোল্ডেন আওয়ার’ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই সময় আরও বেড়ে গেছে। তবে রক্তক্ষরণ অত্যাধিক হলে অর্থাৎ ম্যাসিভ এটাক হলে মৃত্যু ঝুঁকি থাকে।

 

আগেই সচেতন হন 

* নিয়মিত ব্লাড প্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরল চেকআপ করান। 

* ধূমপান, মদ্যপান, মাদকাসক্ত হলে তা বর্জন করা উচিত। 

*মানসিক চাপ কমাতে হবে। যে কোনও প্রতিকূলতা অবস্থায় মনের জোর বজায় রাখুন।  

*ব্রেন স্ট্রোকের বিপদ এড়াতে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা মাস্ট।

*স্ট্রোকের সঙ্গে অত্যাধিক মোবাইল ব্যবহারের প্রত্যক্ষভাবে সংযোগ না থাকলেও এটি মস্তিষ্কে ভুল সংকেত দেয়। ফলে মারণ রোগকে ঠেকাতে স্ক্রিনটাইম নিয়ন্ত্রণে রাখুন। 

*সবুজ শাকসবজি, ফল সহ সুষম খাবার খান। ডিপ ফ্রায়েড, ভাজাভাজি, মিষ্টি যতটা সম্ভব কম খান।

*গর্ভাবস্থায় সন্তান প্রসবের আগে-পরে এবং সন্তান হওয়ার সময়ে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে স্ট্রোক হতে পারে। তাই গর্ভবতীর প্রেশার ঠিক রাখতে হবে। 

*স্ট্রোক এড়াতে নিয়মিত ঘাম ঝরিয়ে শরীরচর্চা করুন। ৩০ মিনিট হাঁটতে বা জগিং করতে পারেন। 

•    পরিবারের কারও স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে ২৫ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করা দরকার।

*মন ভাল রাখুন। অবসরে বই পড়া, গাছের পরিচর্যার মতো কাজ করলে মানসিক চাপ কমবে৷ গান, নাচ, ছবি আঁকা কিংবা কোনও খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন।

*বেশ কয়েকটি শারীরিক সমস্যা যেমন রক্তাল্পতা, বাত, রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার সমস্যা থাকলে সতর্ক থাকুন। 

স্ট্রোকের পর সচেতনতা


স্ট্রোকের পর সঠিক ফিজিওথেরাপি, কাউন্সেলিংও করলেও রোগীকে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। প্রেশার, সুগার থাকলে, মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেলে সঠিক চিকিৎসা করতে হবে৷ এছাড়াও মূত্রথলির কার্যকারিতা, রোগী ঠিকমতো খেতে পারছেন কিনা খেয়াল রাখা জরুরি। রোগীর মনের জোর বাড়াতে প্রিয়জনেদের সহযোগিতাও প্রয়োজন। 

বুঝেশুনে জিমে শরীরচর্চা
  
জিমে ভারী ওজন নেওয়ার আগে বডি চেকআপ করিয়ে নিন। ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, রক্তের ঘনত্ব পরীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। শরীরচর্চার সঙ্গে সঠিক খাওয়াদাওয়া করুন। ঘন্টার পর ঘন্টা নয়, সুনির্দিষ্ট সময়ে জিম করুন। জিমের পর খাওয়াদাওয়া, ধূমপান, মিষ্টি খাওয়া চলবে না। সর্বোপরি কোনও বিশেষ শারীরিক সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের ও জিম ট্রেনারের পরামর্শ নিয়ে ব্যায়াম করুন।