আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট নির্বাচন কমিশন ভারত সরকারের বিরোধীদলনেতা রাহুল গান্ধীকে একটি আলটিমেটাম দিলো। কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর মহাদেবপুরা বিধানসভা এলাকায় ব্যাপক ভোট চুরি হওয়া নিয়ে রাহুল গান্ধী যে অভিযোগ তুলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন তাকে আইনের দিক থেকে শপথপত্র আকারে সেই অভিযোগ উপস্থাপন করার নির্দেশ দিল এবং অন্যথায় জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা বন্ধ করার কথা বললো।

কিন্তু এই ঘটনা শুধু রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি নয়; এটি গত এক দশক ধরে নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার ফলাফল। মহাদেবপুরার ভোটার তালিকা অত্যধিক এবং অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির বিষয়টি কমিশন নিজেই বহু বছর অগ্রাহ্য করে এসেছে। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব তথ্য, গণমাধ্যম প্রতিবেদন ও পূর্ববর্তী কেলেঙ্কারি-ঘটনার আলোকেই বোঝা যায়, একটি সংবিধানিক সংস্থা হিসেবে যাদের দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা, তারা এই সংকটকে গড়ে তোলার পর তা অস্বীকারে লিপ্ত।

অস্বাভাবিক ভোটার বৃদ্ধির পরিসংখ্যান

নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুসারে, কোনো এক নির্দিষ্ট ভোটার তালিকার পুনর্বিবেচনার সময় পূর্ববর্তী তালিকার তুলনায় ৪% এর বেশি ভোটার সংযোজন হলে “অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই” করার কথা। এই ৪% হলো কমিশনের ‘সতর্কতা সঙ্কেত’। মহাদেবপুরায় বিগত দশক ধরে এই সীমা অতিক্রম করেছে এবং প্রত্যেক পাঁচ বছরের ব্যবধানে গড়ে ভোটার বৃদ্ধির হার ৫.৫% থেকে ৬.৮% এর মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে, যা স্পষ্ট সংকেত হওয়া উচিত ছিল।

আরও পড়ুন: চড়-থাপ্পড়-মাটিতে ফেলে মার, ডে-কেয়ারে শিশুকে নৃশংস নির্যাতন, একরত্তির শরীরে মিলল কামড়ের চিহ্নও! নয়ডায় হুলস্থূল

সর্বশেষ ২০২৩ সালের রাজ্য নির্বাচন ও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে মহাদেবপুরার ভোটার সংখ্যা বেড়েছে ৮.৫৪%– যা কমিশনের ৪% সীমার দ্বিগুণেরও বেশি। একই সময়, বেঙ্গালুরু কেন্দ্রীয় লোকসভা আসনের অন্য সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রে ভোটার বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে সর্বোচ্চ ২৬.৫%, বাকি ছয়টি ক্ষেত্রের বৃদ্ধিও ছিল কম। মহাদেবপুরার ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় ১৪০%— যা অন্য সব আসনের তুলনায় অনেক বেশি। তবে, মহাদেবপুরায় প্রযুক্তি ও রিয়েল এস্টেট বুমের ফলে জনসংখ্যা বেড়েছে সত্যিই। কিন্তু ঠিক সেটাই নির্বাচনী বিধান অনুসারে নিয়মিত যাচাইয়ের কারণ হওয়া উচিত ছিল। অতিরিক্ত বৃদ্ধি কোনো ছাড় নয়; বরং এটি অতিরিক্ত নিরীক্ষার দাবি রাখে, যা কমিশন প্রায়শই উপেক্ষা করেছে।

জনসাধারণের সতর্কতা ও স্ক্যান্ডাল

শুধুমাত্র পরিসংখ্যানেই নয়, ২০১৭ সালে “মিলিয়ন ভোটার রাইজিং” নামে একটি নাগরিক উদ্যোগ বেঙ্গালুরুর হোয়াইটফিল্ড এলাকার ভোটার আবেদন প্রক্রিয়ার অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরে। ওই সময় ৬৬% আবেদন বাতিল হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হয়, যার পর কেরলাতের নির্বাচনী আধিকারিক পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেন। যদিও সঠিক সমাধান হয়নি, এবং বিষয়টি কেরালা উচ্চ আদালতে গিয়েছিল।

২০২২ সালে ‘চিলুমে’ নামের একটি এনজিওর বিরুদ্ধে তথ্য অনৈতিক সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে, যা ভোটারদের ব্যক্তিগত তথ্য অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে ভোটার তালিকা থেকে লোকদের বাদ দেওয়ার অভিযোগে কেন্দ্রীয় তদন্ত হয়। সরকারিভাবে এই তথ্য সংগ্রহ ‘অবৈধ’ বলে স্বীকার করা হয়, যদিও প্রমাণিত হয়নি যে এটি ভোট মনিপুলেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। মহাদেবপুরা ছিল চিলুমের কার্যক্রমের তিনটি কেন্দ্রে একটি।

শপথপত্রের রুদ্ধদ্বার

এই প্রেক্ষাপটে, ২০২৫ সালের ৭ আগস্ট রাহুল গান্ধীর দাবি ছিল ১,০০,২৫০ ভোট চুরি হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের জবাব ছিল – অভিযোগ শপথপত্র আকারে দাখিল করতে হবে, নাহলে জনমনে বিভ্রান্তি বন্ধ করতে হবে। সিনিয়র কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী অভিষেক মনু সিংহভী এই শপথ দাবি “সম্পূর্ণ ভুল” বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, এই নিয়মটি ব্যক্তি বিশেষের নির্বাচনী বিরোধের জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু মহাদেবপুরার মতো ব্যাপক ভোটব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই নিয়ম প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন প্রকৃত সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করছে।

সিংহভী আরও বলেন, “একজন নাগরিক যদি ডাকাতির অভিযোগ করে, পুলিশ যদি ডাকাতদের উপেক্ষা করে অভিযোগকারীকে শপথ নিতে বললে সেটি কি গ্রহণযোগ্য হবে?” আসলে সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু মহাদেবপুরায় তারা নিজেদের নিয়ম ও তথ্য উপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়েছে, এখন সেই দায় চাপানো হচ্ছে রাহুল গান্ধীর ওপর।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব: প্রশ্নের মুখে

মহাদেবপুরার ভোটঘটনা এখন আর শুধুমাত্র একটি আসনের বা একজন রাজনীতিবিদের ইস্যু নয়। এটি নির্বাচন কমিশনের গভীর institutional ব্যর্থতার পরিচায়ক। প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচন কমিশন কি আদৌ তার সংবিধানিক দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান? যদি প্রধান তত্ত্বাবধায়করা দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তাহলে “রক্ষাকারীকে কে রক্ষা করবে?” — এই প্রশ্ন উথ্থাপিত হয় বিরোধীপক্ষের মাধ্যমে। মহাদেবপুরার ঘটনাটি আমাদেরকে নির্বাচন ব্যবস্থার জটিলতাকে বোঝার পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধির জন্য তাগিদ দেয়। নিঃসন্দেহে, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী।