গোপাল সাহা
রাত তখন ১টা। ঘরের সব আলো নিভে গেছে। কিন্তু মাথার নীচে একটা আলো তখনও জ্বলছে— স্মার্টফোনের স্ক্রিন। চোখ ক্লান্ত, কিন্তু আঙুল চলতেই থাকে। নেক্সট রিল, নেক্সট গেম, নেক্সট মেসেজ...! তুমি ভাবছো তুমি নিয়ন্ত্রণে আছো। কিন্তু আসলেই কি?
সাম্প্রতিক নিউরোসায়েন্স গবেষণা বলছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের কিশোরদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল। এই সময়টাতেই গড়ে ওঠে:
* আত্মনিয়ন্ত্রণ (self-control)
* মনোযোগ (attention span)
* সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা (decision-making)
* আবেগ নিয়ন্ত্রণ (emotional regulation)
কিন্তু এই সময়ে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোন, রিলস, গেম, সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটে! তাহলে মস্তিষ্কের ওইসব অংশ নানাভাবে বিকৃত হয়ে যায়।
এই ক্ষেত্রে আরও উল্লেখযোগ্য বিষয়, এই মোবাইল ফোন তরুণ প্রজন্মের উপর প্রভাব ফেলার কারণে, এর মধ্যে যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু গুরুতর নেতিবাচক দিকও। এটি যেমন তথ্য, যোগাযোগ এবং বিনোদনের সহজলভ্যতা প্রদান করে। তেমনই, অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক দক্ষতা এবং শিক্ষাগত ফলাফলের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
আরও পড়ুন: বিজেপিকে আক্রমণ করতে গিয়ে এ কী করে বসলেন রাহুল গান্ধী! মৃত নেতাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করলেন
ইতিবাচক প্রভাব:
1. তথ্য ও শিক্ষার অ্যাক্সেস: মোবাইল ফোন তরুণদের বিশাল পরিমাণ তথ্য, শিক্ষামূলক উপকরণ এবং অনলাইন শেখার প্ল্যাটফর্মে সহজে প্রবেশাধিকার দেয়। যার ফলে তারা নিজের গতি ও আগ্রহ অনুযায়ী শেখার সুযোগ পায়।
2. দূরের বন্ধুকে নিয়ে আসে আরও কাছে: এটি বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে সহজে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে, বিশেষত দূরে অবস্থানরতদের জন্য এক ধরনের সম্পর্কের বন্ধন বজায় রাখে।
3. বিনোদন ও অবসর: গেম, সঙ্গীত, ভিডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণরা বিভিন্ন ধরনের বিনোদন উপভোগ করতে পারে, যা অবসরের সময় মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
নেতিবাচক প্রভাব:
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব: অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা ও আত্মমর্যাদাবোধের হ্রাসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
* শারীরিক সমস্যাসমূহ: দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের চাপ, দেহের ভঙ্গির অবনতি এবং ব্লু লাইটের কারণে ঘুমে বিঘ্ন ঘটে।
* সামাজিক দক্ষতার হ্রাস: ভার্চুয়াল যোগাযোগে অতিরিক্ত নির্ভরতা মুখোমুখি কথা বলার ক্ষমতা, সহানুভূতি এবং অমৌখিক সঙ্কেত বুঝতে পারার মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দক্ষতার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
* শিক্ষাগত ফলাফলের অবনতি: মোবাইল ফোন অনেক সময় মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটায়, ফলে সময় নষ্ট হয়, কাজ পেছায় এবং শেষ পর্যন্ত পড়াশোনার ফলাফল খারাপ হয়।
* আসক্তির সম্ভাবনা: মোবাইল ফোনের দ্বারা সৃষ্ট তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ও আনন্দ তরুণদের মধ্যে আসক্তি সৃষ্টি করতে পারে, যা দৈনন্দিন জীবন ও সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
* সাইবার বুলিং ও অনলাইন হয়রানি: ইন্টারনেটে গোপনীয়তা থাকায় অনেক তরুণ সাইবার বুলিং ও অনলাইন হয়রানির শিকার হতে পারে, যার ফলে মানসিক চাপ ও আঘাতের সৃষ্টি হয়।
* গোপনীয়তার ঝুঁকি: ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে ভাগ করার ফলে পরিচয় চুরি, অনলাইন প্রতারণা ইত্যাদি গোপনীয়তার ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়।
আরও পড়ুন: পণ্ডিত নেহরুর স্ত্রী কমলাকে চেনেন? ৩৬ বছর বয়সে মারা গিয়েও সমাজে স্থায়ী প্রভাব রেখে গিয়েছেন
সুপারিশ:
দায়িত্বশীল ব্যবহারে উৎসাহ: তরুণদের মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ঝুঁকিগুলি সম্পর্কে সচেতন করুন এবং সুস্থ ডিজিটাল অভ্যাস গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করুন।
* সময় নির্ধারণ: স্ক্রিনটাইম সীমিত করার ব্যবস্থা নিন এবং খেলাধুলা, শখ, বাইরের খেলাধুলায় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দিন।
* মুখোমুখি যোগাযোগে উৎসাহ: বাস্তব জীবনে সামাজিক যোগাযোগ ও আলাপচারিতা বাড়িয়ে তুলুন, যাতে তরুণদের প্রয়োজনীয় সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠে।
* অনলাইন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ: তরুণদের অনলাইন কার্যকলাপ তদারকি করুন ও গাইডলাইন দিন, যাতে তারা ক্ষতিকর কনটেন্ট থেকে দূরে থাকে এবং অনিরাপদ আচরণে না জড়িয়ে পড়ে।
* মানসিক সুস্থতায় গুরুত্ব: মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে উৎসাহ দিন এবং প্রয়োজনে সহায়তা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখুন।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে মোবাইল ফোনকে ডিজিটাল ড্রাগ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, "কিশোরদের হাতে আজকের সবচেয়ে সহজলভ্য আসক্তির উৎস। স্মার্টফোন এখন শুধু ডিভাইস নয়– এটি তাদের মস্তিষ্কের গঠন, আবেগ, ঘুম, ও আচরণ পাল্টে দিচ্ছে।"
এ বিষয়ে আজকাল ডট ইন-এর মুখোমুখি হয়ে চিকিৎসক তাপস প্রামাণিক বলেন, "আমি দিনে দিনে ১৩–১৬ বছরের কিশোরদের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখছি। ঘুম কমে যাচ্ছে, মনোযোগ ছিঁটকে যাচ্ছে, আচরণ রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। কারণটা একটাই—ফোন।“
তিনি আরও বলেন, "চিকিৎসক হিসেবে আমি এমন কিশোরদের দেখেছি যারা স্মার্টফোন ছাড়া ৩০ মিনিটও থাকতে পারে না। পড়াশোনা, ঘুম, মানসিক স্বাস্থ্য—সব শেষ। অভিভাবকদের বলুন কীভাবে তাঁরা সন্তানের স্ক্রিন টাইম কমাতে পারেন। স্কুলগুলোকে বলুন নিয়মিত 'ডিজিটাল ডিটক্স' কর্মসূচি নিতে। যেমনভাবে tobacco বা junk food-এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তেমনি ‘screen-time guidelines’ বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার।”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পায়েল তালুকদার বলেন, "মোবাইল ফোন যুবসমাজকে ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু অপব্যবহার অনেক বেশি পরিমাণে হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি বর্তমান যুবসমাজের মূলত যুবতীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সে তাঁরা নিজের নগ্ন ছবি শেয়ার করছে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে, যা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে। এছাড়াও মোবাইলে নগ্ন ভিডিও বা ব্লু ফিল্ম দেখা, যৌন কথোপকথন (সেক্স চ্যাট) যা যুবসমাজকে ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে যুবসমাজকে। এই বিষয়টাকে যুব সমাজের নিজেদের যেমন সচেতন হতে হবে একই সাথে খেয়াল রাখতে হবে তাদের বাবা-মাকেও।“
তিনি আরও বলেন, "শিশুদের ক্ষেত্রেও বাবা-মাকেই সচেতন থাকতে হবে, কারণ শিশুদের সামনে বাবা-মা যদি মোবাইল ঘাটতে থাকে সর্বদা তাহলে সেই আসক্তি শিশুদের মধ্যে প্রবলভাবে আকর্ষণ বাড়ায়। প্রয়োজন ছাড়া এবং শুতে যাওয়ার সময় মোবাইলের ব্যবহার একেবারেই হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে ঘুমের যেমন ক্ষতি হয়, একই রকম ভাবে মস্তিষ্কে বিরাট চাপ পরে, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। যুবসমাজের ইনসমনিয়া রোগ একটি বড় কারণ এই মোবাইল এর ব্যবহার।"
