আজকাল ওয়েবডেস্ক: সংসদের অধিবেশনে বুধবার এক আবেগঘন বক্তৃতায় বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের এক প্রায় বিস্মৃত অধ্যায় তুলে ধরলেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মেদিনীপুরে ধারাবাহিকভাবে তিনজন জেলা শাসককে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি দাবি করেন, এই আত্মবলিদান করা বিপ্লবীদের ইতিহাস আজও জাতীয় পাঠ্যক্রমে উপেক্ষিত।
বক্তব্যে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণ করান, ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের অন্যতম বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সেই দিনই সন্ধ্যায় মেদিনীপুরের জেলা শাসক জেমস পেডিকে গুলি করে হত্যা করেন বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষ। পরবর্তীতে তাঁরা আন্দামান সেলুলার জেলে নির্বাসিত হন।
এর পরবর্তী জেলা শাসক রবার্ট ডগলাস আরও নৃশংস দমননীতির পথ নেন। ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে হিজলি জেলে নিরস্ত্র বন্দিদের উপর গুলি চালানোর অভিযোগ তুলে ধরেন রাজ্যসভার সাংসদ। ১৯৩২ সালের ৩০ এপ্রিল সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেন প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য ও প্রবংশু শেখর পাল। ডগলাস নিহত হন, প্রদ্যোৎকে ফাঁসি এবং প্রবংশুকে আন্দামানে পাঠানো হয়।
এই ধারাবাহিক ঘটনায় ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবু ১৯৩৩ সালে বার্নার্ড বার্জ মেদিনীপুরের জেলা শাসকের দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। ২ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুরে একটি ফুটবল প্রদর্শনী ম্যাচ চলাকালীন, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স সংগঠনের পাঁচ বিপ্লবী- ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত, অনাথবন্ধু পাঁজা ও নির্মল জীবন ঘোষ হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে বার্জকে হত্যা করেন। সংঘর্ষে অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্র নিহত হন, এবং বাকি তিনজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর স্বাধীনতা পর্যন্ত মেদিনীপুরে আর কোনও ব্রিটিশ জেলা শাসক নিয়োগ করা হয়নি, এই তথ্য বিশেষভাবে তুলে ধরেন সাংসদ।
বক্তব্যের বাংলা অংশে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করে বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের মহিমা তুলে ধরেন এবং বলেন, আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি বিপ্লবীদের প্রায় ৭০ শতাংশই ছিলেন বাঙালি। তাঁদের ভাষা ছিল বাংলা, তাঁদের কোনও খ্যাতি বা ইতিহাসে স্থান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না, ছিল শুধু দেশের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করা।
তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই বিপ্লবীদের যথোচিত সম্মান দিয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্তরে, বিশেষত NCERT-এর স্কুল পাঠ্যবইয়ে, এই ইতিহাসের কোনও স্থান নেই যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
বক্তব্যের শেষে ইংরেজিতে কটাক্ষ করে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যাঁরা বারবার ক্ষমা চেয়ে পিটিশন লিখেছিলেন, আজ তাঁদেরই উদযাপন করা হয়,” ইঙ্গিত দেন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিপ্লবী ধারার প্রতি দীর্ঘদিনের অবহেলার দিকে।
সংসদের এই বক্তব্য নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন ইতিহাস আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শেখাচ্ছি, আর কোন আত্মত্যাগ আজও পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে যাচ্ছে।
