কৃশানু মজুমদার: তাঁর বকুনি খেয়ে ওডাফা ওকোলি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কিং কোবরা তখন মোহনবাগানের প্রাণভোমরা। ভারতের মারাদোনা কৃশানু দে-র খেলা এখনও ভুলতে পারেন না তিনি। ১৪ বছর আগে লিও মেসির-ম্যাচ পরিচালনা করা তাঁর কাছে অলৌকিক এক ব্যাপার বলেই মনে হয়।
মেসি দ্বিতীয়বার কলকাতায় পা রাখছেন ১৩ ডিসেম্বর। এলএম ১০-এর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তাঁর বাড়িতে রয়ে গিয়েছে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সই করা বল। তিনি বিপ্লব পোদ্দার। মেসি-ম্যাচে তিনিই ছিলেন সহকারী রেফারি। ১৪ বছর অনেকটা সময়। গঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে অনেক জল।
২০১১ সালে মেসির প্রথমবার কলকাতা আগমনের সময় নীল-সাদা জার্সির কিংবদন্তির হাতে উঠেছিল নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড। ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে ক্যাপ্টেন মেসির অভিষেক হয়েছিল যুবভারতীতে।

তাঁর হেডস্যর সাবেয়ারও সেটাই ছিল আর্জেন্টিনার বস হিসেবে প্রথম ম্যাচ। নিকোলাস ওতামেন্দির গোলে বিশালাকায় যুবভারতীতে ভেনিজুয়েলাকে হারিয়ে শেষ হাসি হেসেছিল আর্জেন্টিনা।
এবার অবশ্য মেসি খেলবেন না। তাতে কী! মেসি-মায়ায় এখনও সম্মোহীত বিপ্লব পোদ্দার। তিনি হয়ে উঠছেন নস্ট্যালজিক। বলছিলেন, "অসমের ফুটবল লিগ পরিচালনা করতে আমি গুয়াহাটিতে ছিলাম। তখনই জানতে পারি মেসি-ম্যাচের অ্যাসাইনমেন্টের কথা। তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল হাতে যেন সোনার বল পেয়েছি। অলৌকিক ব্যাপার বলেই মনে হয়েছিল।''
এর পরেও রয়েছে সোনালী মুহূর্ত। শ্রীরামপুরের বিপ্লব পোদ্দার বলতেই পারেন, ''আমি শুধু ঋণী থাকি মুহূর্তের কাছে।'' স্মৃতিচারণ করে বিপ্লব বলছেন, ''টসের পরে মেসি নিজে এসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন। আমাদের সঙ্গে ছবি তোলেন। বিশ্বসেরা ফুটবলার, অথচ দেখে মনে হয় মাটির মানুষ।''
এহেন মেসিই ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হন। সেই মহাকাব্যিক ফাইনালের আগে এবং পরে মেসিকে শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বঙ্গ-রেফারি। তিনি মনে করেন, আগামী বছরের বিশ্বকাপেও মেসি-মায়াকাজল ছড়াবেন।
এবার সামনাসামনি দেখা হলে কী করবেন? বিপ্লব বলছেন, ''মেসিকে শুভেচ্ছা জানাবো। মনে করানোর চেষ্টা করাবো যে এগারো বছর আগে এক ম্যাচে আমিই রেফারি ছিলাম। দারুণ এক উদ্যোগ আয়োজকদের। মেসিকে দেখার জন্য শহর যে মেতে উঠবে, তা বলে দেওয়াই যায়।''
১৩ ডিসেম্বর কলকাতা। ১৪ তারিখ মুম্বই। ১৫ ডিসেম্বর দিল্লিতে পদধূলি পড়বে বিশ্বখ্যাত ম্যাজিশিয়ানের। ১৪ বছর আগের কলকাতাও মেতে উঠেছিল মেসির ছোঁয়ায়। মাঝরাতে শহরে পদার্পণ ঘটেছিল বিশ্ববন্দিত রাজপুত্রের। ভিড়ে ঠাসা বিমানবন্দরের অন্য এক পথ দিয়ে মেসিকে বের করা হয়েছিল। যুবভারতী লাগোয়া হোটেল ছিল তাঁর ঠিকানা। বিপ্লব পোদ্দার বলছেন, ''মেসি চলে যাওয়ার পরেও তার রেশ ছিল। মেসি-ম্যাচ আমাকে পরিচিতি দিয়েছিল। তার পরই আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার কাছে সবাই জানতে চাইছিল সেই ম্যাচের অভিজ্ঞতা।''
একদা মাছ-ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন পুরোদস্তুর সরকারি চাকুরে। ২০১৯ সালে রেফারিং থেকে অবসর নিয়েছেন। রেফারি সংস্থার একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য এখন তিনি। রেফারিদের উন্নয়নের কাজে তিনি নিয়োজিত। আইএফএ-র ম্যাচ কমিশনারও বটে। বিপ্লব বলছেন, ''২০১৩ সালে জাতীয় পুরস্কার হিসেবে সেরা সহকারী রেফারি হয়েছিলাম আমি। বাংলা থেকে আমিই প্রথম। তার পরই তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র আমাকে স্পোর্টস কাউন্সিলের চাকরি দেন। বর্তমান ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস আমাদের চাকরির আরও উন্নয়ন ঘটান।''
১৯৯৮ সালে রেফারিং জগতে তাঁর আবির্ভাব। কেরিয়ারের বিভিন্ন সময়ে দুর্বিনীত ফুটবলারকে বশ করেছেন। বিপ্লব বলছিলেন, ''মোহনবাগান-পুলিশ ম্যাচের কথা মনে পড়ছে। ব্যারেটো-ওডাফা থাকলেও পুলিশের কাছে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল মোহনবাগান। ওডাফা আমার দিকে একবার তেড়ে এসেছিল। আমি ওর দিকে রাগত ভাবে তাকাতেই ওডাফা শান্ত হয়ে চলে যায়।''
কৃশানু দে-র বাঁ পায়ের শিল্প দেখে মুগ্ধ হতেন। যুবভারতীতে মেসির তুলির টান এখনও তাঁর শয়নে, স্বপনে ও জাগরণে। মেসি-র সই সম্বলিত বল তাঁর জীবনের সঞ্চয়। সেই বল তাঁর স্মৃতিতে ফিরিয়ে আনে যুবভারতীর এক স্বর্ণালী সন্ধ্যা। মেসির-সফর নিয়ে পারদ চড়তে শুরু করে দিয়েছে তিলোত্তমায়। শহর কলকাতার মতোই অধীর প্রতীক্ষায় বিপ্লব পোদ্দার। থুড়ি, মেসি-ম্যাচের সহকারী রেফারি।
আরও পড়ুন: ভারতের ট্রফি চুরি করে পাকিস্তানের জাতীয় সম্মান পাচ্ছেন নকভি, সোনার পদক দেওয়া হবে পিসিবি প্রধানকে ...
