আজকাল ওয়েবডেস্ক: নিউ ইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতির এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। অভিবাসী পরিচয়, প্রগতিশীল রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংযোগ—সব ক্ষেত্রেই এই জয় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারতের রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। বিশেষ করে মোদি সরকারের জন্য মামদানির উত্থান এক কৌশলগত মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মামদানি প্রকাশ্যেই মোদি সরকারের ধর্মীয় মেরুকরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন মার্কিন নেতা, যিনি বিশ্বমঞ্চে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী, তাঁর এ ধরনের অবস্থান হিন্দুত্ব প্রকল্পের জন্য বড় ধরনের প্রতিকূলতা তৈরি করছে। কারণ তাঁর বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল নেটওয়ার্ক, ভারতীয় প্রবাসী সমাজ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রতিধ্বনি তুলবে।

মামদানির রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মও আলোচনার কেন্দ্র। তিনি ভাড়া স্থিতিশীলতা, সাশ্রয়ী আবাসন সম্প্রসারণ ও জনকল্যাণমূলক সংস্কার-সহ একধরনের সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক এজেন্ডা সামনে এনেছেন। একই সঙ্গে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গর্বের সঙ্গে বহন করেছেন। বিজয় ভাষণে জওহরলাল নেহরুর বহুত্ববাদী ভারতের স্বপ্ন স্মরণ করা এবং ‘ধুম মচালে’ গানের মধ্য দিয়ে বক্তব্য শেষ করা তাঁর এই সাংস্কৃতিক–রাজনৈতিক মিশ্রণের প্রতীক।

প্রচারণা জুড়ে তিনি বারবার বলেছেন যে তাঁর কাছে ভারতের যে ছবি পৌঁছেছিল তা ছিল বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক—যা মোদি শাসনের ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি বিজেপির বর্তমান ভারতকে বর্ণনা করেছেন এমন একটি দেশ হিসেবে “যেখানে কেবল নির্দিষ্ট ধরনের ভারতীয়দেরই জায়গা আছে”।

হিন্দুত্ব শিবিরের দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিস্থিতি তিনটি বড় স্তরে গুরুত্ব পায়।

প্রথমত, মামদানি মোদির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করছেন। এতদিন বিজেপি সরকার ভারতের ‘গ্লোবাল লিডার’ হিসেবে মোদিকে তুলে ধরে প্রবাসী ভারতীয়দের মাঝে সমর্থন তৈরির চেষ্টা করে এসেছে। এখন একই প্রবাসী সম্প্রদায় থেকেই একজন দৃশ্যমান নেতা মোদি-বিরোধী অবস্থানে দাঁড়ানোয় সেই প্রচার কাঠামোতে ফাটল দেখা দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্বের আন্তর্জাতিক বিস্তারকে মামদানি এক ধরনের প্রতিস্পর্ধা তৈরি করে দিচ্ছেন। হিন্দুত্বপন্থী সংগঠন ও প্রচারণা যে ক্রমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় হয়েছে, মামদানির উত্থান তাতে একটি ‘মিরর এফেক্ট’ তৈরি করে—ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক পশ্চিমী  নেতা, যিনি ভারতের ভেতরের বিরোধী কণ্ঠস্বরকে আন্তর্জাতিক পরিসরে শক্তিশালী করতে পারেন। এর ফলে হিন্দুত্ববিরোধী প্রবাসী গোষ্ঠীগুলোর সাহস ও কার্যকারিতা বাড়বে।

তৃতীয়ত, কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব কম নয়। এতদিন মোদি সরকার ভারত–মার্কিন সম্পর্ককে কৌশলগত সমন্বয়, অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব ও প্রবাসী ভারতীয়দের সেতুবন্ধনের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রও কৌশলগত কারণে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে প্রকাশ্য সমালোচনা এড়িয়ে গেছে। কিন্তু মামদানির অবস্থান এই ভারসাম্যকে জটিল করে তুলছে, কারণ তিনি ভারতের রাজনীতিকে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনায় আনবেন—যা দিল্লির জন্য অস্বস্তিকর।

এ অবস্থায় হিন্দুত্বপন্থী সংগঠনগুলোর সামনে কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প দাঁড়িয়েছে—উপেক্ষা করা, পাল্টা আক্রমণ করা বা সংলাপে যাওয়া। উপেক্ষা করলে তিনি ভারতের বিষয়গুলো আরও জোরালোভাবে উত্থাপন করবেন। আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উল্টো প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। আর সংলাপে গেলে সরকারকে সমালোচনা ও মতভেদ গ্রহণের মতো অবস্থান নিতে হবে, যা হিন্দুত্বের রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

যদিও মামদানি তৎক্ষণাৎ ভারতের রাজনীতিতে বড় কোনও  পরিবর্তন এনে দেবেন—এমন ভাবা ভুল হবে, কিন্তু তাঁর উত্থান আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বহুত্ববাদ নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু করবে। ভারতীয় প্রবাসীদের মধ্যেও সমালোচনাকে ‘অবিশ্বস্ততা’ বা ‘দেশবিদ্বেষ’ হিসেবে দেখার প্রবণতা কমতে পারে। একই সঙ্গে পশ্চিমী  রাজনৈতিক ও মিডিয়া মহলের কাছে বার্তাটি স্পষ্ট: ভারতের সরকারি বয়ান এখন আর প্রবাসীদের মাধ্যমে একচেটিয়াভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে না।

ফলে মামদানি শুধু নিউ ইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র নন—তিনি হিন্দুত্ব প্রকল্পের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের এক নতুন প্রতিপক্ষ, যার অবস্থান ভবিষ্যতে ভারতের রাজনীতি, কূটনীতি ও প্রবাসী সম্প্রদায়ের আলোচনাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।