আজকাল ওয়েবডেস্ক: কর্মব্যস্ত জীবন, ঠাসা রুটিন আর ডিজিটাল দুনিয়ার ক্রমবর্ধমান একাকিত্ব- এই তিনের সাঁড়াশিতে যখন অল্পবিস্তর সকলেই জর্জরিত, তখন সম্পর্কের জগতে নতুন এক পরিভাষা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, যার নাম ‘মাইক্রো-ফ্রেন্ডশিপ’ বা ‘অণু-বন্ধুত্ব’। জেন-জি এবং মিলেনিয়ালদের মধ্যে এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। গাঢ় বন্ধুত্ব বা প্রিয়জনের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের বাইরেও যে ছোট ছোট আলাপচারিতা মানসিক স্বাস্থ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সেই ভাবনা থেকেই এই নতুন ধারার জন্ম।
কী এই মাইক্রো-ফ্রেন্ডশিপ?
সোজা কথায়, মাইক্রো-ফ্রেন্ডশিপ হল সেই সমস্ত মানুষের সঙ্গে আমাদের সংক্ষিপ্ত, ইতিবাচক এবং নিয়মিত কথোপকথন, যাঁদের সঙ্গে আমাদের গভীর কোনও সম্পর্ক নেই। এঁরা আমাদের কাছের বন্ধু নন, আবার সম্পূর্ণ অপরিচিতও নন। যেমন, অফিসের ক্যান্টিনের যে কর্মী প্রতিদিন হাসিমুখে আপনার হাতে চায়ের কাপ তুলে দেন, পাড়ার মোড়ের খবরের কাগজ বিক্রেতা যিনি রোজ সকালে কুশল বিনিময় করেন, জিমের সেই চেনা মুখ যাঁর সঙ্গে শুধু শরীরচর্চার বিষয়েই দু-চার কথা হয়, বা মেট্রোর নিত্যযাত্রী যাঁর সঙ্গে শুধু চোখে চোখ পড়লে একটা সৌজন্যের হাসি বিনিময় হয়।
এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হল এর সংক্ষিপ্ততা এবং দায়বদ্ধতার অপ্রয়োজনীয়তা। এখানে একে অপরের ব্যক্তিগত জীবনের গভীরে যাওয়ার কোনও চাপ থাকে না। দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলা বা দেখা করার কোনও বাধ্যবাধকতাও নেই। উদ্দেশ্য কেবল একটাই- একটি ক্ষণস্থায়ী, হালকা এবং ইতিবাচক সামাজিক আদানপ্রদান।
কেন বাড়ছে এই প্রবণতা?
সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, এই প্রবণতা বাড়ার পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা হাইব্রিড মডেলের কারণে অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা অনেকটাই কমে গিয়েছে। আগে চায়ের বিরতিতে সহকর্মীদের সঙ্গে যে হালকা আলাপচারিতা হত, তার অভাব পূরণ করছে এই অণু-বন্ধুত্ব।
দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব অনেক সময়েই লোকদেখানো এবং ক্লান্তিকর বলে মনে হয়। এর বিপরীতে, মাইক্রো-ফ্রেন্ডশিপের মধ্যে এক ধরনের আন্তরিকতা এবং বাস্তবতা রয়েছে, যা আমাদের একাকিত্ব বোধ কমাতে সাহায্য করে। মনোবিদরা জানাচ্ছেন, মানুষের সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য কেবল ‘স্ট্রং টাই’ বা গভীর সম্পর্কই যথেষ্ট নয়, ‘উইক টাই’ বা এই ধরনের হালকা সম্পর্কগুলোও সামাজিক একাত্মতা বোধ এবং মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
এর উপকারিতা কী?
মাইক্রো-ফ্রেন্ডশিপের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আনন্দের জোগান দেয়। এই ছোট ছোট আলাপচারিতা মস্তিষ্কে ‘ডোপামিন’ এবং ‘অক্সিটোসিন’-এর মতো ‘ফিল-গুড’ হরমোনের ক্ষরণ বাড়াতে সাহায্য করে, যা আমাদের মেজাজ ভাল রাখে এবং মানসিক চাপ কমায়। এটি আমাদের মধ্যে এক ধরনের সম্প্রদায়ভুক্তির অনুভূতি তৈরি করে। নিজের পাড়া, অফিস বা নিত্যদিনের যাতায়াতের পথে যখন একাধিক চেনা মুখের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় হয়, তখন নিজেকে আর একা বা বিচ্ছিন্ন মনে হয় না।
আসলে ‘মাইক্রো-ফ্রেন্ডশিপ’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের বড় বড় সম্পর্কের ভিড়ে এই ছোট ছোট আলাপচারিতার মুহূর্তগুলোও কম দামী নয়।
