আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিশ্বজুড়ে যখন পরিবেশ সচেতনতা এবং চামড়ার বিকল্প উপাদানের খোঁজ বাড়ছে, তখন ফ্যাশন ও শিল্প জগতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন মেক্সিকোর দুই উদ্যোগপতি আদ্রিয়ান লোপেজ ভেলার্দে এবং মার্তে কাজারেজ। প্রাণীজ চামড়া বা প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পৃথিবীকে মুক্তি দিতে তাঁরা তৈরি করেছেন এক বিশেষ ধরনের ‘ভেগান লেদার’, যার মূল উপাদান তাঁদেরই দেশের মরু অঞ্চলের একটি গাছ। অতি পরিচিত এই গাছের নাম নোপাল ক্যাকটাস যা ‘প্রিকলি পেয়ার’ নামেও খ্যাত। দুই বন্ধু এই উদ্ভাবনী পণ্যের নাম রেখেছেন ‘ডেসের্তো’, যা ফ্যাশনের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলেই মনে করছেন অনেকে।
আদ্রিয়ান ও মার্তে, দুজনেই একসময় ফ্যাশন, আসবাবপত্র এবং অটোমোবাইল শিল্পে কর্মরত ছিলেন। সেখানেই তাঁরা চাক্ষুষ করেন পরিবেশের উপর প্রথাগত প্রাণীজ এবং সিন্থেটিক চামড়ার বিধ্বংসী প্রভাব। চর্মশিল্পে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, জলের অপচয় হয় এবং রাসায়নিক দূষণ দেখা দেয়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতেই নতুন বিকল্পের সন্ধান করা শুরু করেন তাঁরা। দীর্ঘ দুই বছরের গবেষণার পর তাঁরা এমন একটি উপাদান খুঁজে পান, যা কেবল মেক্সিকোতে সহজলভ্যই নয়, পরিবেশের জন্যও আশীর্বাদস্বরূপ। সেই উপাদানটিই হল নোপাল ক্যাকটাস। এই ভাবনা থেকেই ২০১৯ সালে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন নিজেদের সংস্থা।
ডেসের্তো তৈরির পদ্ধতিটিও তার গুণের মতোই অনন্য এবং পরিবেশবান্ধব। মেক্সিকোর জাকাতেকাস প্রদেশের একটি খামারে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে এই ক্যাকটাসের চাষ করা হয়। এর জন্য কোনওরকম রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এমনকী, এই ক্যাকটাসের বেড়ে ওঠার জন্য আলাদা করে সেচের জলেরও প্রয়োজন হয় না, বৃষ্টির জলই যথেষ্ট। প্রতি ছয় থেকে আট মাস অন্তর শুধুমাত্র পরিণত ক্যাকটাসের পাতাগুলি কেটে নেওয়া হয়, মূল গাছটিকে সম্পূর্ণ অক্ষত রাখা হয়। এর ফলে একই গাছ থেকে বছরের পর বছর ধরে পাতা সংগ্রহ করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর একমাত্র সাদা জিরাফ কোথায় থাকে? কার ভয়ে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা হয় তাকে? জানলে চোখে জল আসবে
এরপর সেই পাতাগুলিকে তিন দিন ধরে রোদে শুকিয়ে গুঁড়ো করা হয়। অবশেষে, সেই গুঁড়োর সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব ফর্মুলায় তৈরি জৈব-পলিমার মিশিয়ে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে চামড়ার রূপ দেওয়া হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই প্রক্রিয়ায় কোনও বিষাক্ত রাসায়নিক, যেমন— থ্যালেটস বা পিভিসি (পলি ভিনাইল ক্লোরাইড) ব্যবহার করা হয় না। ফলে, ডেসের্তো আংশিকভাবে বায়োডিগ্রেডেবল, অর্থাৎ এটি পরিবেশে মিশে যেতে পারে, সিন্থেটিক চামড়ার মতো দূষণ ছড়ায় না।
আরও পড়ুন: পৃথিবীর একমাত্র সাদা জিরাফ কোথায় থাকে? কার ভয়ে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা হয় তাকে? জানলে চোখে জল আসবে
এই ক্যাকটাস লেদার তার গুণমানের জন্যও বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এটি অত্যন্ত নরম, নমনীয় এবং আসল চামড়ার মতোই টেকসই। আসল চামড়ার মতোই এই ভেগান চামড়াও ‘ব্রিদেবল’। ফলে এই চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক, জুতো বা ব্যাগ বেশ আরামদায়ক। বিষয়টি এতই অদ্ভুত যে ডেসের্তোর ব্যবহার এখন আর শুধু ফ্যাশন দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। ঘড়ি, ব্যাগ, জুতো থেকে শুরু করে বিলাসবহুল গাড়ির সিট কভারিং এবং আসবাবপত্র তৈরিতেও এর চাহিদা বাড়ছে। ইতিমধ্যেই মার্সিডিজ-বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, ফেরারি, কার্ল লেগারফেল্ড এবং এইচঅ্যান্ডএম-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলি তাদের বিভিন্ন পণ্যে এই চামড়ার ব্যবহার শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে আদ্রিয়ান এবং মার্তের এই উদ্ভাবন চর্মশিল্পে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। তাঁদের এই প্রচেষ্টা প্রমাণ করে, প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখেই আধুনিক, রুচিশীল এবং বাণিজ্যিক পণ্য তৈরি করা সম্ভব, যা আগামী দিনের দূষণমুক্ত পৃথিবীর পথ প্রশস্ত করবে।