আজকাল ওয়েবডেস্ক: বহুদিন ধরেই আমরা ব্যক্তিত্বকে মূলত অন্তর্মুখী (ইন্ট্রোভার্ট) এবং বহির্মুখী (এক্সট্রোভার্ট)-এই দুই ভাগে ভাগ করতে অভ্যস্ত। কেউ ভিড় ভালোবাসেন, সামাজিক মেলামেশায় শক্তি পান; আবার কেউ একাকিত্বে খুঁজে নেন নিজের জগৎ। কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা এই দুই ধরনের কোনওটিতেই ঠিকঠাক খাপ খান না। তাঁরা হয়তো ব্যক্তিগত স্তরে অত্যন্ত মিশুক এবং গভীর সম্পর্ক গড়তে সক্ষম, কিন্তু কোনও দল বা গোষ্ঠীর অংশ হতে গেলেই তাঁদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে। মনোবিজ্ঞানের জগতে এই ধরনের ব্যক্তিত্বকে চিহ্নিত করতে সম্প্রতি একটি নতুন শব্দ যোগ হয়েছে- ‘ওট্রোভার্ট’ (Otrovert)।
মার্কিন মনোবিদ রামি কামিনস্কি এই ধারণাটির প্রবক্তা। ‘ওট্রোভার্ট’ শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ শব্দ ‘ওট্রো’ (যার অর্থ ‘অন্য’) এবং ল্যাটিন শব্দ ‘ভার্ট’ (যার অর্থ ‘দিকে মুখ করে থাকা’) থেকে। অর্থাৎ, ওট্রোভার্ট হলেন সেই ব্যক্তি যিনি অন্যদের থেকে ভিন্ন দিকে মুখ করে থাকেন। কামিনস্কির মতে, ওট্রোভার্টরা অন্তর্মুখী বা বহির্মুখীর মাঝখানে থাকা কোনও উভমুখী ব্যক্তিত্ব নন, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শ্রেণী।
ওট্রোভার্ট কারা?
একজন ওট্রোভার্ট ব্যক্তি এক বা একাধিক মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত গভীর এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। তাঁরা বন্ধুবৎসল, সহানুভূতিশীল এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় যখন তাঁরা কোনও বৃহত্তর গোষ্ঠীর অংশ হন। সেটা অফিসের টিম হোক, বন্ধুদের দল বা কোনও সামাজিক সংগঠন। দলবদ্ধতার ধারণাটিই তাঁদের মধ্যে একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করে। অর্থাৎ, তাঁরা দলের প্রতিটি সদস্যকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করলেও, ‘দল’ বা ‘গোষ্ঠী’ নামক সামগ্রিক সত্তাটির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারেন না। ভিড়ের মাঝে থেকেও তাঁরা হয়ে থাকেন চিরন্তন বহিরাগত।
অন্তর্মুখীদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়?
অন্তর্মুখীদের মূল সমস্যা হল, সামাজিক মেলামেশা তাঁদের মানসিক শক্তি নিঃশেষ করে দেয়, তাই তাঁরা একাকিত্বেই সাবলীল। কিন্তু ওট্রোভার্টদের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। তাঁরা মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতে পারেন, কিন্তু গোষ্ঠীগত মানসিকতার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন না। একজন অন্তর্মুখী মানুষ নিজের পরিবার বা একটি ছোট বন্ধুদলের অংশ হিসেবে একাত্মবোধ করতে পারেন। কিন্তু একজন ওট্রোভার্টের কাছে এই একাত্মতার অনুভূতিটাই অনুপস্থিত।
ওট্রোভার্ট হওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা
যেহেতু ওট্রোভার্টরা কোনও গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য অনুভব করেন না, তাই তাঁরা অন্যের মতামতের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হন না। তাঁদের চিন্তাভাবনা হয় মৌলিক এবং স্বাধীন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ তাঁদেরকে এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎকে দেখার সুযোগ করে দেয়, যা সৃষ্টিশীলতা এবং নতুন ধারণার জন্ম দেয়। কামিনস্কির মতে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, ফ্রিডা কাহলো বা ভার্জিনিয়া উলফের মতো ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ওট্রোভার্ট সুলভ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা তাঁদের যুগান্তকারী কাজের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
তবে এর অসুবিধাও রয়েছে। যে সমাজে একাত্মতা এবং দলবদ্ধতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেখানে ওট্রোভার্টদের প্রায়শই ভুল বোঝা হয়। তাঁরা নিজেরাও অনেক সময় ‘কেন আমি খাপ খাওয়াতে পারি না’-এই ভেবে হীনম্মন্যতায় ভোগেন।
সুতরাং, এরপর যদি এমন কাউকে দেখেন যিনি ব্যক্তিগত পরিসরে অসাধারণ কিন্তু কোনও দলেই ঠিক স্বচ্ছন্দ নন, তবে তাঁকে অসামাজিক বা উন্নাসিক ভেবে বসার আগে একবার ওট্রোভার্ট ধারণাটির কথা ভাবতে পারেন। তাঁর এই বিচ্ছিন্নতাই হয়তো তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি।
