আজকাল ওয়েবডেস্ক: পাকিস্তানে যেন চতুর্থ সামরিক কূপের সূচনা হয়েছে। তবে এবার সেটি হচ্ছে সম্পূর্ণ নীরবে, বন্দুকের ঝনঝনানি বা মধ্যরাতের দখলদারি ছাড়াই। এটিকে বলা হচ্ছে এক ধরনের ‘সাংবিধানিক কূপ’, যেখানে গণতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবহার করেই সামরিক কর্তৃত্ব বৈধ করার চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন সরকারকে অনেকেই বলছেন একটি ‘পাপেট রেজিম’, যার মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির নিজের ক্ষমতার পরিসরকে আরও বিস্তৃত করছেন।


সম্প্রতি পাকিস্তানের সিনেট যে ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করেছে, সেটিই এই ‘নরম কূপ’-এর কেন্দ্রবিন্দু। এই সংশোধনী কার্যত সামরিক শাসনকে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে বৈধতা দিতে চায়, যেখানে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভা, এমনকি বিচারব্যবস্থার অংশ বিশেষকেও জেনারেল মুনিরের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণাধীন করা হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল—এতে পাকিস্তানের সামরিক শৃঙ্খলা, পারমাণবিক কর্তৃত্ব এবং আন্তঃবাহিনী সমন্বয়ের ওপর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে মুনিরের হাতে।
এটি ভারতের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ভারত যেখানে সামরিক নেতৃত্বের অধীনে সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত হয়, সেখানে পাকিস্তানে সামরিক আধিপত্য আরও শক্তিশালী হওয়া এক ধরনের অস্থিতিশীল সামরিক অসমতা তৈরি করতে পারে।


পাকিস্তানের ইতিহাসে অতীতে তিনটি সামরিক কূপ ঘটেছে—আয়ূব খান (১৯৫৮), জিয়া-উল-হক (১৯৭৭) ও পারভেজ মোশাররফ (১৯৯৯)। কিন্তু জেনারেল মুনিরের নেতৃত্বে চলা এই চতুর্থ ‘নীরব কূপ’কে অনেকেই পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতাকেন্দ্রীকরণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। এমন কিছু, যা জিয়া কিংবা মোশাররফও করতে পারেননি।


এই ‘সাংবিধানিক কূপ’-এ মুনিরের সহযোগী হিসেবে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। সংশোধনীটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে মুনিরকে নিয়ে তৈরি করা হয় Chief of Defence Forces (CDF) নামে একটি নতুন সুপার-পজিশন, যা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব দেবে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকা সামরিক কমান্ডের সাংবিধানিক কাঠামো বাতিল করে এই নতুন ক্ষমতা কাঠামো দাঁড় করানো হচ্ছে।


অদ্ভুতভাবে, এই সংশোধনীটি পাস হওয়ার সময়ই ছিল মুনিরের নির্ধারিত অবসরের মাত্র কয়েকদিন আগে। ফলে অনেকেই মনে করছেন—এটি মূলত তাঁর ‘পদায়ু’ বাড়ানোর এবং তাকে পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা।


এই সংশোধনীর আরেকটি অংশ আরও বেশি বিতর্কিত। সাংবাদিক ইমরান রিয়াজ খানের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ-তারকা জেনারেল বা সিডিএফকে সব ধরনের আইনি দায়মুক্তি দেওয়া হবে। এর ফলে সামরিক বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।


পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র—সরকার, আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থার বড় অংশ—এই বদলের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলছে না।
সরকারপন্থীরা বলছেন, অপারেশন সিন্দুরের সময় পাকিস্তান সামরিকভাবে যেসব দুর্বলতা দেখেছে, তা মোকাবিলায় নতুন ধরনের সামরিক কাঠামো প্রয়োজন। কিন্তু সমালোচকদের মতে—এই পরিবর্তন বৈধ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানকে একটি সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত করবে।


পাকিস্তানের ইতিহাসে নীরব, সাংবিধানিক মোড়কে এমন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা আগে কখনও দেখা যায়নি—আর সেটিই এই ঘটনাকে আরও গভীরভাবে উদ্বেগজনক করে তুলেছে।