আজকাল ওয়েবডেস্ক: মাত্র কয়েক সপ্তাহ অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট বা মানসিক অবসাদরোধী ওষুধ খাওয়ার পরই যৌন আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন বহু মানুষ—এমনই এক চমকে দেওয়া চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপজুড়ে রোগীদের বিবৃতিতে। কেউ কেউ বলছেন, ওষুধ বন্ধ করার বছরখানেক পরও তাদের যৌন ক্ষমতা, অনুভূতি ও এমনকি যৌনাঙ্গের আকার পর্যন্ত বদলে গেছে।
২৪ বছরের ম্যাক্সওয়েল মার্টিনিস, ওহাইও-র বাসিন্দা, মাত্র দু’মাস প্রোজ্যাক (Prozac) নামক জনপ্রিয় অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট খাওয়ার পরেই জীবনের স্বাভাবিক যৌনতা হারিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই রোগ আমার মানসিক ও শারীরিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যে উদ্বেগের জন্য ওষুধ খেয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা এখন এই নিস্তেজ জীবনে।”
ওয়াশিংটন ডিসির লেক্সি লাইওস (২৬) জানান, মাত্র তিন দিন প্রোজ্যাক খাওয়ার পরই তার যৌনাঙ্গ সঙ্কুচিত হতে শুরু করে। বছর কেটে গেলেও শরীরে কোনও পরিবর্তন ফেরেনি। “আমি আকর্ষণ বোধ করি, কিন্তু শরীর সাড়া দেয় না। মনে হয় মস্তিষ্ক আর যৌনাঙ্গের মধ্যে কোনও সংযোগ নেই,” বলেন তিনি।
এই সব হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে একদল চিকিৎসক সম্প্রতি FDA (Food and Drug Administration)-র বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাদের অভিযোগ, সংস্থাটি বহু বছর ধরে রোগীদের সতর্ক করতে ব্যর্থ হয়েছে যে SSRI ধরনের অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ওষুধ যৌনজীবনে দীর্ঘমেয়াদি—এমনকি স্থায়ী—ক্ষতি করতে পারে।
“পোস্ট-SSRI সেক্সুয়াল ডিসফাংশন” (PSSD) নামে পরিচিত এই অবস্থাটি ২০০৬ সালে চিকিৎসক আন্তোনেই চোকা ও স্টুয়ার্ট শিপকো প্রথম সংজ্ঞায়িত করেন। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, SSRI ওষুধ বন্ধ করার পরেও রোগীদের একটি বড় অংশ বহু বছর যৌন অনুভূতি হারিয়ে ফেলেন, এমনকি অর্গাজমও পান না।
নিউইয়র্কের পুরুষ যৌনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. ববি বেরুকিম বলেন, “প্রতিদিনই আমরা এমন রোগী দেখি। এই ওষুধ মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য ও হরমোন নিয়ন্ত্রণকে এমনভাবে বদলে দেয় যে যৌন উত্তেজনা নষ্ট হয়ে যায়।”
গবেষণায় জানা গেছে, SSRI ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো যৌন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ভোগেন—যেমন কমে যাওয়া লিবিডো, ইরেকশন সমস্যার সৃষ্টি বা অর্গাজমে অক্ষমতা।
কানাডা সরকার ইতিমধ্যেই ২০২১ সালে স্বীকার করেছে যে এই যৌন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ওষুধ বন্ধ করার পরেও “সপ্তাহ থেকে বছর পর্যন্ত” স্থায়ী হতে পারে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো পর্যন্ত ওষুধের লেবেলে এ ধরনের সতর্কবার্তা নেই।
নিউফাউন্ডল্যান্ডের ৫১ বছর বয়সি অ্যামান্ডা ক্লার্ক জানান, প্রোজ্যাক ও পরে সিলেক্সা (Celexa) খাওয়ার পর ধীরে ধীরে তার আবেগ ও যৌনতা উভয়ই নিঃশেষ হয়ে যায়। “আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, সন্তান চাইতাম—কিন্তু সবকিছু ধীরে ধীরে নিভে গেল,” বলেন তিনি।
এই রোগীদের দাবি, তাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে মানসিক স্বাস্থ্যচিকিৎসায় আরও সতর্কতা, রোগী-সচেতনতা ও বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, উদ্বেগ বা বিষণ্ণতা সারাতে গিয়ে যদি মানুষ নিজের শারীরিক আনন্দ, প্রেম ও প্রজননের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে—তবে সেটি নিঃসন্দেহে এক নীরব জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়।
বিশ্বজুড়ে অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট ব্যবহারের হার দ্রুত বাড়ছে—কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ৩৮ মিলিয়নের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ও ৬.৫ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরী এই ওষুধে নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই প্রয়োজন এই ওষুধগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে স্বচ্ছ গবেষণা ও কঠোর সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, না হলে মানসিক সুস্থতার বদলে মানবজীবনের মৌলিক অনুভূতিই হারিয়ে যেতে পারে।
