আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে ঘিরে বিতর্ক ক্রমেই বাড়ছে। ঘোষণার পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলছে, একজন এমন রাজনীতিককে কীভাবে শান্তির প্রতীক হিসেবে পুরস্কৃত করা যায়, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং গাজা উপত্যকার নিরস্ত্র প্যালেস্তাইনের  জনগণের ওপর বোমা হামলার ঘটনায় প্রকাশ্যে সমর্থন না দিলেও, সেই রাষ্ট্রনীতির ঘোর সমর্থক হিসেবে পরিচিত। মাচাদো নিজে সরাসরি প্যালেস্তাইনের গণহত্যার পক্ষে মন্তব্য না করলেও, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান এবং অতীত কর্মকাণ্ড তাঁকে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী করে তুলেছে বলেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে।

হামাসের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আকস্মিক আক্রমণের পর মাচাদো প্রকাশ্যে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি হামাসের ওপর তীব্র আক্রমণ করে বলেছিলেন, এটি “সন্ত্রাসবাদ” এবং “যে কোনো রূপে সন্ত্রাসবাদকে পরাস্ত করা দরকার।” সেই সময় তিনি বিরোধী প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এবং তাঁর এই মন্তব্য স্পষ্টভাবে মার্কিন–ইজরায়েলি অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল। ফলে, শান্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন আরও গভীর হয়েছে।

মাচাদোর রাজনৈতিক দল ভেন্তে ভেনেজুয়েলা ২০২০ সালে ইজরায়েলের ডানপন্থী দল লিকুদ-এর সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল “রাজনৈতিক, মতাদর্শগত ও সামাজিক ইস্যু, কৌশল, ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তা নিয়ে সহযোগিতা।” উল্লেখ্য, লিকুদ দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু, যিনি বর্তমানে গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যার কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত। মাচাদো ২০১৯ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন, “ভেনেজুয়েলার সংগ্রামই ইজরায়েলের সংগ্রাম।” এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল–সমর্থিত শক্তির সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এই পুরস্কারের ঘোষণার সময়টিই তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই ক্যারিবিয়ানে যুদ্ধজাহাজ ও প্রায় চার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে, ভেনেজুয়েলার উপকূলে বিমান হামলা চালিয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর মাথার ওপর “বাউন্টি” ঘোষণা করেছে।
অর্থাৎ একদিকে সামরিক আগ্রাসন, অন্যদিকে “শান্তি পুরস্কার”—এই দ্বৈত কৌশল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির পুরনো রীতি: আগ্রাসনকে নৈতিকতায় আচ্ছাদিত করা। মাচাদো প্রকাশ্যে এই মার্কিন হামলার সমর্থন করেছেন, বলেছেন “স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে” এটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ফলে তাঁর নোবেল পাওয়া অনেকের কাছে “পুরস্কার নয়, পুরস্কৃত আনুগত্যের প্রতিদান।”

আরও পড়ুন: পাত্তা পেল না ট্রাম্পের কাকুতি-মিনতি, শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলনেত্রী

মারিয়া কোরিনা মাচাদো হলেন সেই রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতিনিধি, যারা ভেনেজুয়েলার বলিভারীয় সমাজতান্ত্রিক প্রকল্পকে ধ্বংস করতে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন অনুদান ও কূটনৈতিক সহায়তা পেয়েছেন। তিনি ২০০২ সালে হুগো শাভেজ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে একাধিক সূত্রে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর সংস্থা ‘সুমাতে’ (Súmate) মার্কিন সংস্থা National Endowment for Democracy (NED)-এর আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল, যা প্রায়শই CIA-র পরোক্ষ হাতিয়ার হিসেবে অভিযুক্ত।

বলিভারীয় বিপ্লবের পর থেকে ভেনেজুয়েলা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক অবরোধে জর্জরিত। দেশের তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে, মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া। প্রায় আট মিলিয়ন মানুষ বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছেন। এই মানবিক সংকটের জন্মভূমি হচ্ছে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ ও পুঁজিবাদী বিশ্ববাজারের চাপে তৈরি কাঠামোগত শোষণ। অথচ এই প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করেই নোবেল কমিটি ভেনেজুয়েলার বর্তমান সরকারকে “স্বৈরতান্ত্রিক” আখ্যা দিয়ে বিরোধী নেতৃত্বকে পুরস্কৃত করছে।

২০১৮ সালে মাচাদো নাকি নেতানিয়াহুকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি ভেনেজুয়েলার তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সরকারকে দুর্বল করতে “শক্তি প্রয়োগের” প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন বলে কিছু সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন, ভেনেজুয়েলার সরকার ইরান ও কিছু “চরমপন্থী গোষ্ঠীর” সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। যদিও পরে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, সেই চিঠির প্রসঙ্গ দেশীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল এবং সেটি ইজরায়েলের সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি। কিন্তু বাস্তবে এই ঘটনাগুলি একত্রে প্রমাণ করে যে মাচাদোর পররাষ্ট্র–দৃষ্টিভঙ্গি শান্তি বা গণতন্ত্রের আদর্শের চেয়ে বেশি প্রভাবিত মার্কিন–ইজরায়েলি ভূরাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা।

এই বছরের নোবেলকে ঘিরে ছিল এক ধরনের রাজনৈতিক নাটক। ট্রাম্প বারবার ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি “সাতটি যুদ্ধ বন্ধ করেছেন” এবং তাই শান্তি নোবেলের যোগ্য। বিশ্লেষকদের মতে, নোবেল কমিটি সরাসরি তাঁকে না দিয়ে বরং এমন এক প্রার্থী বেছে নিয়েছে যিনি মার্কিন আগ্রাসী নীতির প্রতীক, ফলে কার্যত ট্রাম্পের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই পুরস্কৃত করা হলো।

বিশ্লেষকদের মতে, একজন এমন রাজনীতিককে শান্তি নোবেল দেওয়া কেবল একটি নৈতিক বিতর্ক নয়, বরং এটি বর্তমান বিশ্বে “শান্তি” ধারণাটির রাজনৈতিক অপব্যবহারের উদাহরণ। লাতিন আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তথাকথিত “গণতন্ত্র রক্ষাকারী” বিরোধীদের আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। সেই ধারাবাহিকতাতেই মাচাদো এখন এক আন্তর্জাতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তাঁর ইজরায়েলপন্থী অবস্থানও সেই বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী জোটের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক অভিন্নতা স্পষ্ট করে।

মাচাদোর এই পুরস্কারকে অনেকেই দেখছেন একধরনের “রাজনৈতিক বিনিয়োগ” হিসেবে—যেখানে নোবেল কমিটি প্রকৃত শান্তির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির আদর্শগত সম্প্রসারণকেই পুরস্কৃত করেছে। যেভাবে অতীতে ওবামাকে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ চলাকালেই শান্তি নোবেল দেওয়া হয়েছিল, সেভাবেই এবারও পুরস্কারটি বাস্তব শান্তির নয়, বরং ক্ষমতার নৈতিক ছদ্মবেশে পরিচালিত এক সাম্রাজ্যবাদী রণকৌশলের অংশ।

বর্তমান গাজা পরিস্থিতি, ভেনেজুয়েলার ওপর মার্কিন অবরোধ, এবং লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী শক্তির ওপর চলমান দমননীতির প্রেক্ষিতে মারিয়া কোরিনা মাচাদোর নোবেল জয় বিশ্ব রাজনীতির এক অস্বস্তিকর সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছে—“শান্তি” এখন আর নিপীড়িতদের রক্ষার ভাষা নয়, বরং আধিপত্যের শুদ্ধিকরণ প্রকল্পের অংশ। এই পুরস্কার দেখিয়ে দেয়, নোবেল কমিটির নৈতিক ভাষা যতই মানবিক হোক, তার বাস্তব প্রয়োগ এখন পুঁজিবাদী ভূরাজনীতির অনুবর্তী হয়ে পড়েছে।