আজকাল ওয়েবডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে জাতীয় গান ‘বন্দে মাতরম’-এর ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আগামী এক বছর ধরে দেশজুড়ে বিশেষ উদ্যাপন হবে। স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণার উৎস এই গানটি প্রথম রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পরে তিনি সেটি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠ-এর অন্তর্ভুক্ত করেন (১৮৮২)। কিন্তু এই উদ্যাপনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে শুরু হয়েছে নতুন আলোচনা—এই গানটি আসলে কাদের দেশপ্রেমের প্রতীক, আর কাদের কাছে তা ছিল এক গভীর বঞ্চনার স্মারক।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসের পটভূমি স্থাপিত ১৮ শতকের শেষ দিকে, যখন বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। সে সময় বাংলার শাসনে ছিলেন এক নামমাত্র নবাব, আসল ক্ষমতা ছিল লোভী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। তবু উপন্যাসে বঙ্কিম দায় দেন মুসলিম নবাবের ওপর, আর সেই ব্যক্তিগত অপরাধকে বিস্তৃত করে তোলেন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের “অন্তর্নিহিত দুষ্কর্ম”-এর রূপে। বাস্তবের ইতিহাসে যে সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, বঙ্কিম সেখানে মুসলমান চরিত্রগুলিকে একেবারে মুছে ফেলেন।
উপন্যাসে দেখা যায় একদল উচ্চবর্ণ সন্ন্যাসী হিন্দু গ্রামবাসীদের উসকে দিচ্ছে মুসলমানদের ওপর হামলা চালাতে—তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে, মসজিদ ভাঙতে, এমনকি মৃতদেহের মুখে পা দিতে। যুদ্ধে জেতার পর আবার জাতিভেদ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও থাকে তাদের। দেবী দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী—এই তিন দেবীর মিশ্র রূপে বঙ্কিমের সৃষ্ট মাতৃদেবী রূপ নেন ‘মাতৃভূমি’। প্রথম দুটি স্তবক মৃদু সুরে ভূমির সৌন্দর্য ও শস্যভাণ্ডারের প্রশস্তি গায়, কিন্তু পরের স্তবকগুলি যুদ্ধের আহ্বানে রূপ নেয়—গদা, খড়গ, বজ্রধ্বনি আর রক্তাক্ত সংগ্রামের ডাক।
রাজনৈতিক ইতিহাসে এই গান নানা প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে। কংগ্রেস গানটিকে গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে, আবার হিন্দুত্ববাদীরা ব্যবহার করেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্লোগান হিসেবে। বঙ্কিমের জীবদ্দশাতেই মুসলিম সমাজের মধ্যে এ নিয়ে গভীর অস্বস্তি দেখা দেয়। ইসলামে দেবতার মানবীয় মূর্তি স্বীকার করা যায় না, ফলে মাতৃদেবীরূপে মাতৃভূমির পূজা তাদের কাছে পরাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে। উপন্যাসের মুসলিমবিরোধী ভাষাও তাদের ক্ষুব্ধ করেছিল।
১৯৩০-এর দশকে এই ক্ষোভ আরও তীব্র হয়। কেন্দ্রীয় প্রদেশের কংগ্রেস সরকার সরকারি স্কুলে ‘বন্দে মাতরম’ গাওয়া বাধ্যতামূলক করলে মুসলিম লীগ তীব্র আপত্তি জানায়। বিখ্যাত কবি জসীমউদ্দিন এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তাঁর দুঃখ প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে ১৮৯৪ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে গানটি গেয়েছিলেন, কিন্তু ১৯১৫ সালে রচিত তাঁর উপন্যাস ঘরে বাইরে-এ তিনি স্পষ্ট করে দেখান এই গানের সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক বিপদ। তাঁর মতে, দেশ মানে মানুষ আর মাটি—তার দেবীকরণ মানে বাস্তবকে বিমূর্ত করে তোলা।
গান্ধী প্রথমে গানটির প্রশংসা করলেও ১৯৪৬-৪৭ সালের দাঙ্গার পর মত বদলান। নেহরুও ১৯৩৭ সালে আনন্দমঠ পড়ে উদ্বিগ্ন হন এবং রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চান। রবীন্দ্রনাথ বলেন, প্রথম দুটি স্তবক যেহেতু কেবল ভূমির সৌন্দর্য গায়, সেগুলি গাওয়া যেতে পারে; কিন্তু পরের অংশে যুদ্ধ ও ধর্মীয় সহিংসতার আহ্বান থাকায় তা বাদ দেওয়াই শ্রেয়। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে গণপরিষদ সেই দুই স্তবককেই জাতীয় গান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, আর রবীন্দ্রনাথের ‘জন গণ মন’ হয় জাতীয় সঙ্গীত।
বর্তমানে বিজেপি ও আরএসএস এই গানটির পূর্ণাঙ্গ রূপকে দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। দলের নেতা রাম মাধব সাম্প্রতিক এক লেখায় দাবি করেছেন, কংগ্রেস নেতারা ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্যই গানটির কিছু অংশ বাদ দিয়েছিলেন। তিনি কংগ্রেসের অবস্থানকে “সাম্প্রদায়িক আপস” হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, যদিও আনন্দমঠ-এর মুসলিমবিরোধী অংশ নিয়ে তাঁর কোনো মন্তব্য নেই।
ইতিহাসবিদদের মতে, বিজেপির এই উদ্যাপন রাজনৈতিকভাবে বোধগম্য—কারণ ধর্মীয় আবেগকে দেশপ্রেমের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া আজকের হিন্দুত্ব রাজনীতির অন্যতম কৌশল। ‘আনন্দমঠ’-এর উপন্যাস ও গান যেখানে দেবী মাতৃভূমির জন্য পুত্রদের যুদ্ধের আহ্বান জানায়, সেখানে দেবতা নয়, ভক্তরাই দেবীর রক্ষক। এই ধারণা হুবহু মেলে সমসাময়িক হিন্দুত্ববাদী বক্তব্যের সঙ্গে, যেখানে রামের জন্মভূমি “রক্ষার” দায়ও নেয় তাঁর ভক্তরা।
তবে বঙ্কিমচন্দ্রের মন ছিল জটিল ও বহুমাত্রিক। তাঁর শেষ উপন্যাস সীতারাম-এ দেখা যায়, এক আদর্শবাদী হিন্দু রাজা মুসলমান শত্রুকে হারিয়ে হিন্দু রাজ্য গড়ে তোলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই সেই নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে ওঠে, যা আগে মুসলমান শাসকদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁর পতনের পর এক সৎ ফকিরের কণ্ঠে বঙ্কিম লেখেন—“এখন আর হিন্দু রাজ্যে বাস করা সম্ভব নয়।”
১৫০ বছর পরে ‘বন্দে মাতরম’-এর উদ্যাপন তাই কেবল এক সাহিত্যিক শ্রদ্ধাঞ্জলি নয় বরং এটি আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে ইতিহাস, ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের জটিল সম্পর্কের প্রতিফলন।
