আজকাল ওয়েবডেস্ক: সম্প্রতি ‘অপারেশন মহাদেব’-এ লস্কর-ই-তইবার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গি হাবিব তাহির ওরফে ‘ছোটু’কে ভারতীয় বাহিনী হরওয়ানে নিকেশ করার পরপরই কাশ্মীরের সীমান্ত পেরিয়ে আলোড়ন ছড়াল পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে)। যদিও প্রথমে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে এটিকে একটি কৌশলগত বিজয় হিসেবেই দেখা হয়েছিল, তবে পরে যা ঘটল ছোটুর গ্রামের কুয়িয়ানে, তা হয়তো সীমান্তপারে কোনো বিমান হানার থেকেও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে।
ছোটুর পরিবার লস্কর ও তার সহযোগী সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়ার উপস্থিতি সরাসরি নিষিদ্ধ করে দেয় শেষকৃত্যে। সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যখন স্থানীয় লস্কর কমান্ডার রিজওয়ান হানিফ অস্ত্রধারী দলবল নিয়ে হাজির হন, তখনই শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ। স্থানীয় এক যুবক তার দিকে বন্দুক তাক করলে, উত্তেজিত জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হানিফ পালিয়ে বাঁচেন। যে ভূখণ্ডে এতদিন ভয়ের সংস্কৃতি মুখ বন্ধ করে রেখেছিল মানুষকে, সেখানে একটিবারেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট।
এই প্রতিরোধ কেবল শেষকৃত্যের ময়দানে আটকে থাকেনি। পিওকে-র বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এক নতুন ধরনের নাগরিক অস্বীকৃতি। কুয়িয়ান ও খায়ালা গ্রামের মানুষ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ‘জিগরা’ নামে এক প্রাচীন গ্রাম পঞ্চায়েত বৈঠকের আয়োজনের, যেখানে প্রকাশ্যেই সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি নিয়োগের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা হবে। ছেলেরা সীমান্ত পেরিয়ে “জিহাদ”-এর নামে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, কফিনবন্দি হয়ে ফিরে আসা – এই বেদনার এক স্বাভাবিক বিস্ফোরণ যেন এই প্রতিবাদ।
ছোটুর প্রাক্তন শিক্ষক লিয়াকত আলি, যিনি ‘সরদার বিলাল’ নামেও পরিচিত, একটি আট মিনিটের ভিডিও বার্তায় বলেন, “কারা আমাদের সন্তানদের মগজ ধোলাই করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখোমুখি পাঠাচ্ছে? যারা নিজেদের সন্তানদের আমেরিকা আর ইংল্যান্ডে পড়াতে পাঠায়, তারা অন্যের ছেলেদের দিয়ে জিহাদ করাচ্ছে।” এই ভিডিওটি পিওকে-র নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এনক্রিপ্টেড চ্যাট গ্রুপে, ব্যক্তিগত শেয়ারিংয়ে – প্রতিবাদের নয়, বরং ক্লান্ত বাস্তবতার স্বীকারোক্তি হিসেবেই।
আরও পড়ুন: যৌনাঙ্গ ছোট বলে হেয় নয়, মগজাস্ত্রেই মাত করতেন এই দেবতারা! ভাস্কর্যের বিস্ময়কর ইতিহাস ফাঁস!
এমনকি প্রশাসনিক স্তরেও এই হাওয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাগ জেলার খুরাহাটে যখন নওমান শেহজাদ নামে এক ব্যক্তি একটি সম্মেলনের অনুমতি চান, যেখানে কট্টর মতাদর্শের অনুরাগী কিছু বক্তা উপস্থিত থাকার কথা ছিল, তখন প্রশাসন সেই অনুমতি বাতিল করে “জননিরাপত্তা” ও “পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা”-র কারণ দেখিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেট’-এর কথায় চলা প্রশাসনের এই নীরব রদবদল তাৎপর্যপূর্ণ।
এদিকে, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব পিওকে-র এই বেসামরিক প্রতিরোধকে তাদের কৌশলগত অবস্থানের নৈতিক ও কৌশলগত বিজয় হিসেবে তুলে ধরছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যসভায় বলেন, “পিওকে কংগ্রেস দিয়েছিল, বিজেপিই ফিরিয়ে আনবে।” প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, “যে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন পিওকের মানুষ নিজেরাই ভারতে ফিরতে চাইবে।”
তবে প্রতিবাদ যতই জমাট বাঁধুক, শত্রুপক্ষ থেমে নেই। ডেকান হেরাল্ড-এর একটি রিপোর্টে প্রকাশ, পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই ইতিমধ্যেই পিওকে-র বিভিন্ন এলাকায় — আথমুকাম, লিপা, কোটলি, কাহুতা, চমনকোট — ছোট ছোট জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেছে। এই ক্যাম্পগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে স্যাটেলাইট ও থার্মাল ট্র্যাকিং এড়ানো হচ্ছে।
এখনো এটা কোনও সংগঠিত বিদ্রোহ নয়। রাজনৈতিক পতাকা বা স্লোগানের ছায়াতেও নয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে নির্মিত ভয়ভীতির সংস্কৃতির ভেতর এক অদৃশ্য ভাঙন শুরু হয়েছে। পিওকে-র মানুষ, যারা এতদিন চুপ ছিলেন, আজকে এক একটি 'না' উচ্চারণ করছেন — জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, পাকিস্তানের সেই দাবির বিরুদ্ধে যে তারা নাকি 'মুক্তির প্রতীক'। পাকিস্তান এখন নতুন শত্রুর মুখোমুখি — নিজের তৈরি করা ভূখণ্ডের মানুষ।
