আজকাল ওয়েবডেস্ক: কেন্দ্রীয় সরকার শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে চারটি শ্রমসংহিতা— কোড অন ওয়েজেস (২০১৯), ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড (২০২০), অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশনস (ওএসএইচডব্লিউসি) কোড (২০১৯) এবং সোশ্যাল সিকিউরিটি কোড (২০২০)— কার্যকর করেছে। একইসঙ্গে ২৯টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইন বাতিল করা হয়েছে, ফলে বহু দশক ধরে চলা খণ্ডিত, সেক্টরভিত্তিক শ্রম-আইন কাঠামোকে পরিবর্তন করে একীভূত চার কোডের ব্যবস্থায় আনা হল।
কোন কোন আইন বাতিল হল
নতুন সিস্টেম চালুর ফলে নিম্নলিখিত শ্রম আইনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল হয়েছে—
১. মজুরি সংক্রান্ত ৪ আইন
পেমেন্ট অফ ওয়েজেস অ্যাক্ট, ১৯৩৬
মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট, ১৯৪৮
পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট, ১৯৬৫
ইক্যুয়াল রিমিউনারেশন অ্যাক্ট, ১৯৭৬
২. শিল্প সম্পর্ক সংক্রান্ত ৩ আইন
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউটস অ্যাক্ট, ১৯৪৭
ট্রেড ইউনিয়নস অ্যাক্ট, ১৯২৬
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস) অ্যাক্ট, ১৯৪৬
৩. নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ সংক্রান্ত ১৩ আইন
ফ্যাক্টরিস অ্যাক্ট ১৯৪৮, মাইনস অ্যাক্ট ১৯৫২, ডক ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট ১৯৮৬, বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট ১৯৯৬, কনট্রাক্ট লেবার অ্যাক্ট ১৯৭০, ইন্টার-স্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট ১৯৭৯, প্ল্যান্টেশনস লেবার অ্যাক্ট ১৯৫১, ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস অ্যাক্ট ১৯৫৫, ওয়ার্কিং জার্নালিস্টস (রেটস অফ ওয়েজেস) অ্যাক্ট ১৯৫৮, বিড়ি ও সিগার ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট ১৯৬৬, মোটর ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট ১৯৬১, সেলস প্রোমোশন এমপ্লয়িজ অ্যাক্ট ১৯৭৬, সিনে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড সিনেমা থিয়েটার ওয়ার্কার্স অ্যাক্ট ১৯৮১।
৪. সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত ৯ আইন
এমপ্লয়িজ কম্পেনসেশন অ্যাক্ট ১৯২৩, ইএসআই অ্যাক্ট ১৯৪৮, ইপিএফ অ্যাক্ট ১৯৫২, এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জেস অ্যাক্ট ১৯৫৯, ম্যাটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট ১৯৬১, পেমেন্ট অফ গ্র্যাচুইটি অ্যাক্ট ১৯৭২, সিনে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড অ্যাক্ট ১৯৮১, কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স সেস অ্যাক্ট ১৯৯৬, আনঅর্গানাইজড ওয়ার্কার্স সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০০৮।
নতুন চার শ্রমসংহিতা কী দিচ্ছে?
কোড অন ওয়েজেস, ২০১৯
“মজুরি”-র জন্য দেশজুড়ে অভিন্ন সংজ্ঞা প্রয়োগ।
ন্যূনতম মজুরি সব কর্মীকে প্রদান বাধ্যতামূলক, শুধু নির্দিষ্ট ‘সিডিউল্ড এমপ্লয়মেন্ট’ নয়।
অতিরিক্ত সময়ে দ্বিগুণ হারের মজুরি।
মজুরি প্রদানে দেরি হলে আর্থিক জরিমানা ও পুনরাবৃত্তিতে কারাদণ্ডের বিধান।
বেতন স্লিপ, রেজিস্টার ও কঠোর পেমেন্ট-টাইমলাইন বাধ্যতামূলক।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০
ট্রেড ইউনিয়নের বৈধ স্বীকৃতির বিধান— ‘নেগোশিয়েটিং ইউনিয়ন’ বা ‘নেগোশিয়েটিং কাউন্সিল’।
ছাঁটাই কর্মীদের জন্য ‘রিস্কিলিং ফান্ড’, যেখানে নিয়োগকর্তার পক্ষ থেকে ১৫ দিনের মজুরি জমা দিতে হবে।
“স্ট্রাইক”-এর ধারণা সম্প্রসারিত: ৫০% কর্মীর একযোগে ক্যাজুয়াল লিভ নেওয়াও এখন ধর্মঘট।
ছাঁটাই, লে-অফ ও ক্লোজার-এর ক্ষেত্রে অনুমতি চাওয়ার বাধ্যবাধকতা ৩০০ কর্মীর উপরে সীমাবদ্ধ।
ওএসএইচডব্লিউসি কোড, ২০১৯
১০ বা তার বেশি কর্মী থাকা সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একক রেজিস্ট্রেশন।
দুর্ঘটনা ও বিপজ্জনক ঘটনার রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক।
সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের “ওয়ার্কার” হিসেবে স্বীকৃতি— নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ আইন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
মহিলাদের রাত ৭টার পরে কাজ করার অনুমতি— শর্ত সাপেক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সম্মতি।
নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিনামূল্যে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
বাড়ি থেকে কাজ (Work-from-home)কেও “ওয়ার্কপ্লেস” হিসেবে অন্তর্ভুক্ত— এরগোনমিক নীতি ও নিরাপত্তার দায় নিয়োগকর্তার।
অনিয়োজিত, গিগ, প্ল্যাটফর্ম ও অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য জাতীয় ডাটাবেস (NDUW) সৃষ্টির বিধান।
কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি, ২০২০
পিএফ, ইএসআই, গ্র্যাচুইটি, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও ওয়েলফেয়ার বোর্ডকে একত্রিত কাঠামোয় আনা।
নির্ভরশীলতার সংজ্ঞা সম্প্রসারিত।
গিগ ও প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের আইনি স্বীকৃতি— অ্যাগ্রিগেটরদের অবদান বাধ্যতামূলক।
ফিক্সড-টার্ম কর্মীদের জন্য এক বছরের চাকরির পরই গ্র্যাচুইটির অধিকার।
মাতৃত্বকালীন ছুটির পর মহিলাদের জন্য বাড়ি থেকে কাজের বিধান— পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে।
সমালোচনা: নতুন শ্রমসংহিতার মূল উদ্বেগ
১. ধর্মঘটের অধিকার সংকুচিত
স্ট্রাইক ঘোষণার আগাম নোটিশ, নিষিদ্ধ সময়সীমা বৃদ্ধি এবং ‘মাস ক্যাজুয়াল লিভ’-কে ধর্মঘট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা— এগুলোকে শ্রমিক সংগঠনগুলি গুরুতর বাধা হিসেবে দেখছে।
২. সুরক্ষার সীমা বাড়িয়ে কর্মী অধিকার হ্রাস
স্ট্যান্ডিং অর্ডারস প্রয়োগের সীমা ৩০০ কর্মীতে উন্নীত হওয়ায় ছোট-মাঝারি প্রতিষ্ঠানের বিপুল সংখ্যক কর্মী এই সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন।
৩. সহজতর ছাঁটাই
৩০০-এর নিচে কর্মী থাকা সংস্থাগুলি সরকারকে না জানিয়েই সহজে ছাঁটাই বা ইউনিট বন্ধ করতে পারবে।
৪. জটিল মজুরি সংজ্ঞা
মজুরি সংজ্ঞায় ৫০% ক্যাপ আরোপ এবং ভাতা-নির্ভর বেতন কাঠামোতে বাধা— নিয়োগকর্তাদের জন্য জটিল হিসাবনিকাশ ও বহু আইনের সম্ভাব্য লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
৫. বহু বিধান এখনো ভবিষ্যতের নিয়মনির্ভর
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে— গিগ কর্মীর সুবিধা, কাজের সময়, সুরক্ষা নিয়ম— সংশ্লিষ্ট উপবিধি এখনো প্রকাশিত নয়।
৬. একক রেজিস্ট্রেশন খাতভিত্তিক তদারকি কমাতে পারে
ওএসএইচডব্লিউসি কোডের একক লাইসেন্স ব্যবস্থায় খাতভেদে বিশেষ তদারকি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৭. বাড়ি থেকে কাজের স্বীকৃতি পেলেও সুরক্ষা কম
ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমে কাজের সময়, নিরাপত্তা, ব্যয় ভাগাভাগি— কোনও ক্ষেত্রেই স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
৮. রূপান্তর পর্যায়ে প্রশাসনিক চাপ বৃদ্ধি
২৯টি আইন থেকে চার কোডে পরিবর্তন আনতে রেজিস্ট্রেশন, রেকর্ড-কিপিং, এইচআর ও পেরোল পরিবর্তন— সব মিলিয়ে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
নতুন শ্রমসংহিতা কার্যকর হওয়ার পর শনিবার কংগ্রেস, বাম দল এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসহ বহু সংগঠন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। তাদের অভিযোগ— এই সংহিতাগুলি “কর্পোরেটপন্থী, শ্রমিক-বিরোধী এবং গণতান্ত্রিক পরামর্শ ছাড়াই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে”।
কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ এক্স (X)-এ লিখেছেন—শ্রম আইনগুলোকে কেবল “রিপ্যাকেজিং” করে তুলে ধরা হচ্ছে, কোডগুলির উপবিধি এখনো প্রকাশিত হয়নি, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ₹৪০০, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, শহুরে কর্মসংস্থান গ্যারান্টি, অসংগঠিত শ্রমিকদের সমগ্র সামাজিক সুরক্ষা— কোনও বিষয়েই পরিষ্কার উত্তর নেই। তিনি আরও বলেন— কর্ণাটক ও রাজস্থানের কংগ্রেস সরকার গিগ কর্মীদের জন্য অগ্রণী আইন করেছিল, কেন্দ্র তার থেকে শিক্ষা নিক।
ফরোয়ার্ড ব্লকের নিন্দা
অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক জি. দেবরাজন চার কোডকে “একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া শ্রমিক-বিরোধী আইন” বলে আখ্যা দেন। তিনি ২৬ নভেম্বরের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে বলেন— সরকার ট্রেড ইউনিয়নদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি, বরং ব্যবসায়ী স্বার্থ রক্ষায় আইনগুলো পাস করেছে।
সিপিআই(এম)-এর তীব্র বক্তব্য
সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো বলেছে— এই কোডগুলো “জঙ্গলরাজ” প্রতিষ্ঠা করবে, শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিয়ে কর্পোরেটদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা তুলে দেবে, ২৯টি আইন শ্রমিকদের ন্যূনতম সুরক্ষা দিত— নতুন কোড সেগুলো দুর্বল করছে, ধর্মঘট ও সমষ্টিগত আন্দোলনের অধিকার কার্যত খর্ব করা হচ্ছে।
সিপিআই-এর মতামত
দেবনাথ রাজা (ডি. রাজা) X-এ লিখেছেন— কোডগুলো “চাকরির নিরাপত্তার মৃত্যুঘণ্টা” এবং দেশের শ্রমিকদের অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ বিবৃতি
১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ ফোরাম এই বিজ্ঞপ্তিকে “ইচ্ছামত”, “অগণতান্ত্রিক” ও “শ্রমিক-বিরোধী” বলে উল্লেখ করেছে।
একটি মাত্র সমর্থন: বিএমএস
আরএসএস-ঘনিষ্ঠ ভারতীয় মজদুর সংঘ (বিএমএস) এই কোডকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে— ন্যূনতম মজুরি সম্প্রসারণ ও অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা— আধুনিক কর্মশক্তির বাস্তব চাহিদাকে প্রতিফলিত করে।
শ্রম আইন কাঠামোর আমূল রদবদল ভারতের শ্রমক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তন আনল। যেখানে সরকার এটিকে দক্ষতা, আধুনিকীকরণ ও একীভূত নিয়ন্ত্রণের পথে পদক্ষেপ বলছে, সেখানে বিরোধীরা দেখছেন শ্রমিক অধিকার ক্ষয়ের আশঙ্কাজনক সংকেত। কোডগুলির বহু উপবিধি এখনও প্রকাশিত না হওয়ায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠছে, এবং আগামী মাসগুলোতে শ্রম বাজারে এর বাস্তব প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
