আজকাল ওয়েবডেস্ক: রাজ্যজুড়ে বস্তি উচ্ছেদ, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দিয়ে মুসলিম ও বাংলা ভাষাভাষীদের নিশানা বানানো—এমন প্রবণতা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিপজ্জনক আকার নিয়েছে। শহরের পরিকাঠামো নির্মাণে যাদের শ্রম অপরিহার্য, সেই প্রান্তিক মানুষগুলোর নাগরিকত্ব এখন প্রশ্নের মুখে। মুর্শিদাবাদের ২৫ বছর বয়সি স্যুজন সরকারও এর শিকার।
বসুদেবপুর গ্রামের বাসিন্দা সুজন জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে দুর্বল, কৃষিশ্রমিকের কষ্টকর কাজ করতে অক্ষম। জমিজমা নেই, তাই জীবিকার খোঁজে কয়েক মাস আগে পাড়ি দেন ওড়িশার ধেনকানালে, প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ফেরি করতে। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা রোজগার হচ্ছিল। কিন্তু ১ জুলাই এক ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি।
সেদিন দেঙ্গুয়াবাড়ি এলাকায় এক ব্যক্তি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি ভারতীয় না বাংলাদেশি, হিন্দু না মুসলিম। নিজের পরিচয় জানানোর পর ওই ব্যক্তি হঠাৎই তাকে কাপড় খুলতে বাধ্য করেন। সুজনের কথায়, “আমি ভেবেছিলাম সাহায্য চাইবেন, কিন্তু নগ্ন করে মারধর শুরু করেন। পিঠ, হাঁটুতে আঘাত করেন, চারপাশে ভিড় জমলেও কেউ বাধা দেয়নি।” সুজনের বাবা সত্যবান সরকারের প্রশ্ন, “নিজের দেশে ধর্মের জবাব দিতে হবে কেন? আমাদের গ্রামে হিন্দু-মুসলিম মিলেই থাকি, ঝামেলা হয়নি কখনো।”
আরও পড়ুন: ভারতে পারমাণবিক হামলার হুমকি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের! সতর্ক কেন্দ্র
মারধরের পাশাপাশি সুজনকে ‘হনুমান চালিশা’ আবৃত্তি করতে বলা হয়। তিনি জানতেন না, ফলে মার আরও বাড়ে। একপর্যায়ে হামলাকারী ভারী পাথর দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হলে একজন এগিয়ে এসে তাকে পালাতে বলেন। প্রায় অচেতন অবস্থায় স্যুজন মোটরবাইকে চেপে ভাড়াবাড়িতে ফেরেন। ঘটনার পর থানায় অভিযোগ দায়ের হলেও অভিযুক্ত দ্রুত জামিনে মুক্তি পায়। ঠিকাদার জানিয়ে দেন, কাজ চালিয়ে যেতে হলে ওই এলাকায় ফিরে গিয়ে ‘স্থানীয়দের বিরক্ত না করতে’ হবে। অবশেষে বাবার চাপের মুখে ঠিকাদার ট্রেনের টিকিট কেটে স্যুজনকে বাড়ি পাঠায়।
সুজনের মা শেফালি সরকারের কথায়, “দুই বাচ্চা আছে ওর। এখানে কাজ করে যা পায়, তাতে সংসার চলে না। ওড়িশায় খরচ বাদে মাসে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে পারত। সেই টাকা দিয়ে ঘরের ছাদ দিতে চেয়েছিলাম।” রাজ্যের তুলনায় বাইরে ন্যূনতম মজুরি বেশি হওয়ায় (ওড়িশায় ১২,০১২ টাকা, মুম্বইয়ে ১২,৫২৫ টাকা) গ্রাম ছেড়ে যাওয়া প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
মারধরের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই ৪ আগস্ট ‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্যমঞ্চ’-এর সহযোগিতায় নাগপুরে নতুন কাজে যোগ দেন স্যুজন—রেলস্টেশন ঝাঁট দেওয়ার কাজ, মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন, সঙ্গে খাবার ও থাকার ব্যবস্থা। ফোনে সংক্ষিপ্ত আপডেটে তিনি বলেন, “এখানকার অবস্থা ভালো, অন্য বাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে থাকি। পুজোর আগে বাড়ি ফিরব।” রাজ্য সরকারের তথ্য বলছে, গত এক মাসেই মুর্শিদাবাদ থেকে ১৪৬ জন পরিযায়ী শ্রমিক হেনস্থার কারণে ফিরে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের মারধর বা চুরি খবরের শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু স্যুজনের ঘটনা আলাদা—এটি সরাসরি এক প্রকার গণপিটুনি।
বাঙালিদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে যে ঘৃণার রাজনীতি তৈরি হয়েছে, তার শিকার সুজন। সেই ভিড়ের নীরবতা, সেই উদাসীন দৃষ্টি—সবই যেন জানান দিচ্ছে, এই ঘৃণার শেষ কোথায় কেউ জানে না। হাতে শুধু একটুকরো ট্রেনের টিকিট, মায়ের স্বপ্নে আঁকা ছাদ, আর পুজোর আগে সন্তানের জন্য নতুন পোশাক কেনার আশা—এই নিয়েই আবারও রাজ্যের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
