আজকাল ওয়েবডেস্ক: বিহারে ভোটার তালিকার "Special Intensive Revision" (SIR) প্রক্রিয়া নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্কের মধ্যেই ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গতকাল (১০ জুলাই) এই বিতর্কিত পুনর্বিন্যাস স্থগিত না করলেও এর সময় এবং পদ্ধতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আদালতের মতে, এই প্রক্রিয়া ভারতের গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ—ভোটাধিকার—এর উপরেই সরাসরি আঘাত করছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণ: ভোটার যাচাই না যেন নাগরিকত্ব নির্ধারণ?
আদালতে জমা দেওয়া একাধিক মামলার শুনানিতে বিচারপতিদের বেঞ্চ নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছে যাতে আধার কার্ড, EPIC (ভোটার কার্ড) ও রেশন কার্ডকে বৈধ নথি হিসেবে বিবেচনা করা হয় ভোটার তালিকা হালনাগাদের ক্ষেত্রে। তবে এই প্রস্তাবনা নির্বাচন কমিশনের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে—বাধ্যতামূলক নয়।
নির্বাচন কমিশন শুনানিতে দাবি করেছিল, আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় এবং তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়। আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ভোটার তালিকা সংশোধনের এই প্রক্রিয়া নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য নয়, বরং পরিচয় প্রমাণের জন্য। বিচারপতিরা আরও বলেন, বর্তমান স্বীকৃত ১১টি নথির একটিও নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ নয়—তবে তা পরিচয় যাচাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাহলে আধার, যা প্রায়শই অন্যান্য নথির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় (যেমন: জাতি বা বাসস্থান সনদ), সেটিকে বাদ দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।
আধার বাতিল মানেই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা
বিহারের বাস্তব চিত্র হলো, রাজ্যের প্রায় ৮৭% মানুষ আধার কার্ড ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, মাত্র ৪৫-৫০% মানুষ মাধ্যমিক পাশ এবং ২%-এর কমের পাসপোর্ট আছে। এই পরিসংখ্যান দেখায় যে আধার বাদ দিলে বিশাল সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
গোপনীয়তা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দ্বৈত নীতি
আদালত পর্যবেক্ষণ করে যে নির্বাচন কমিশন এমন এক বিভাজন তৈরি করেছে—২০০৩ সালের আগে ভোটার তালিকায় নাম ওঠা ব্যক্তিরা নিরাপদ, কিন্তু পরবর্তী যারা, তাঁদের আবার প্রমাণ দিতে হবে যে তাঁরা ভারতীয় নাগরিক। এই নীতি অসাংবিধানিক ও অস্পষ্ট, কারণ একবার নাম তালিকাভুক্ত হলে সেই নাগরিককে বারবার প্রমাণ দিতে হবে না।
তাছাড়া জানুয়ারি ২০২৫-এ শেষ হওয়া সাধারণ সংশোধন প্রক্রিয়া এবং জুন ২০২৫ পর্যন্ত চলা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের কর্তারা নিজেরাই তালিকা নির্ভুল নিশ্চিত করেছেন। তাহলে হঠাৎই কেন এই বিশেষ যাচাই, তা আজও অস্পষ্ট। নির্বাচন কমিশনের এই আচরণ বিরোধিতা করেছে নিজেদের পূর্ববর্তী ঘোষণার সঙ্গেই।
স্থানীয় পর্যায়ে বিভ্রান্তি, নিয়মবিধিতে অসঙ্গতি
বিহারে তৃণমূল পর্যায়ে বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়েছে দুই স্তরের কমিশনের দ্বন্দ্ব: রাজ্যের মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক যেখানেই লঘু মানদণ্ডে নথি গ্রহণ করছেন, কেন্দ্রীয় কমিশন তা খারিজ করে দিচ্ছে। একদিকে পাটনায় আধার গ্রহণ করা হয়েছে, অন্যদিকে অন্য জেলাগুলোতে তা বাতিল হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ এখানেই গুরুত্বপূর্ণ: গ্রহণযোগ্য নথির তালিকা সম্প্রসারণ না হলে বিপুল সংখ্যক ভোটার বঞ্চিত হতে পারেন।
আরও পড়ুন: সাধারণ স্কলারশিপের টাকা আটকে রেখে মোদির প্রচারে ৫২২% বেশি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রের!
গণতন্ত্রের মূল প্রশ্নে পৌঁছেছে এই মামলা
এখন প্রশ্ন শুধুমাত্র ভোটার আইডি নথির নয়—এটি গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত ন্যায্যতা ও অংশগ্রহণের অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। সংবিধানের ৩২৪ ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের কাজ ভোটাধিকারের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা, তা সীমাবদ্ধ করা নয়।
আদালতের পরবর্তী পদক্ষেপ
সুপ্রিম কোর্ট আগামী শুনানির দিন ধার্য করেছে ২৮ জুলাই—ঠিক চার দিন আগে খসড়া তালিকা প্রকাশের শেষ তারিখ। সেই সময় প্রক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে যাবে, তখন নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে যে আর কিছু করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আদালত যদিও আপাতত প্রক্রিয়া বন্ধ করেনি, তবে দরজা খোলা রেখেছে—যদি আইনি ত্রুটি ধরা পড়ে, সংশোধন বা স্থগিতাদেশ তখন দেওয়া হতে পারে।
ভোটাধিকার শুধু আইনগত অধিকার নয়, গণতন্ত্রের ভিত্তি
বিচারব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ভারতীয় নাগরিকদের ভোটাধিকার বারবার প্রমাণের বিষয়টি সংবিধান পরিপন্থী। প্রশাসনিক অনিয়ম, নীতি-ভ্রষ্টতা কিংবা অস্পষ্ট নির্দেশনা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। ভোটাধিকার শুধু একটি নাম তালিকাভুক্ত করার বিষয় নয়—এটি একটি জাতির প্রতিশ্রুতি, যে প্রতিটি নাগরিক, তাঁর জাত, শ্রেণি বা পরিচয় যাই হোক না কেন, সমানভাবে এই রাষ্ট্রের অংশ। এই মুহূর্তে বিহারের ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া সেই জাতীয় প্রতিশ্রুতিরই একটি কঠিন পরীক্ষা।
