আজকাল ওয়েবডেস্ক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ বার্ষিক মূল্যায়ন প্রকাশিত হওয়ার দিনেই ভারতে আজ, শুক্রবার, চলতি আর্থিক বছর ২০২৫-২৬-এর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের জিডিপি তথ্য প্রকাশিত হওয়ার কথা। কিন্তু তার ঠিক আগেই আইএমএফ-এর এই মূল্যায়ন কেন্দ্রীয় সরকার এবং নয়াদিল্লিকে অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে অর্থনৈতিক মহলের অভিমত। সংস্থাটি ভারতের জাতীয় হিসাবপত্র—জিডিপি, জিভিএ, ভোগ ব্যয়, বিনিয়োগ—সহ গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের মান নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে দিয়েছে এবং সেই ভিত্তিতে ভারতের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস ডেটাকে দিয়েছে ‘C’ গ্রেড, যা চারটি গ্রেডের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। অর্থাৎ, এই তথ্যপ্রণালীতে এমন কিছু ভিত্তিগত ও পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে যা আন্তর্জাতিক নজরদারি, তুলনা এবং নির্ভরযোগ্য মূল্যায়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আইএমএফ-এর ‘Article IV’ রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ভারতের জাতীয় পরিসংখ্যানের প্রকাশের ধারাবাহিকতা  ও সময়নিষ্ঠতা গ্রহণযোগ্য হলেও তা সংগ্রহ, পদ্ধতি ও বিশ্লেষণ—তিন ক্ষেত্রেই দুর্বলতা বহন করছে। এ নিয়ে বিরোধীরা ২০১৪ সালের পর থেকেই প্রশ্ন তুলে আসছিল, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সংসদীয় বিতর্কে বা নীতি আলোচনায় সেগুলি গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে একই অভিযোগ উঠে আসায় সরকারের পরিসংখ্যান-ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে।

সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে জিডিপি গণনার পদ্ধতি নিয়ে। এখনও পর্যন্ত ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে বর্তমান উৎপাদন কাঠামো, আয়-ব্যয়ের ধরন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং সেবাখাতের আধিপত্য—এসব সাম্প্রতিক বৈশিষ্ট্য ডেটাতে  প্রতিফলিত হয় না। পাশাপাশি প্রযোজক মূল্য সূচক (PPI) চালু না থাকায়, জিডিপি গণনায় ডিফ্লেটর হিসেবে বর্তমানে ব্যবহার করতে হচ্ছে পাইকারি মূল্য সূচক (WPI), যা উৎপাদন খরচের প্রকৃত পরিবর্তনকে পুরোপুরি প্রতিফলিত করতে পারে না। আরও উদ্বেগের বিষয়, উৎপাদনভিত্তিক জিডিপি এবং ব্যয়ভিত্তিক জিডিপির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান থেকে যাচ্ছে, যা ইঙ্গিত করে যে দেশের ব্যয় নির্ভর তথ্য সংগ্রহ পর্যাপ্ত নয় এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও ব্যয় প্রায়ই গণনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আইএমএফ আরও উল্লেখ করেছে, ভারতের ত্রৈমাসিক জিডিপি এখনও নির্দিষ্ট সময় অনুসারে  সমন্বয় করা হয় না, ফলে বাস্তবিক অর্থনৈতিক প্রবণতা বিশ্লেষণে অসুবিধা হয় এবং কখনও কখনও তা বিভ্রান্তিকর সংকেতও তৈরি করে।

শুধু জাতীয় হিসাবই নয়, মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপেও একই ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করেছে আইএমএফ। উপভোক্তা মূল্য সূচক (CPI) নিয়মিত ও দ্রুত প্রকাশিত হলেও তার ভিত্তিবর্ষ এবং পণ্যের সম্ভার  পুরনো, ফলে তা এখনকার ব্যয় কাঠামো বা ভোগ আচরণের পরিবর্তনকে সঠিকভাবে ধরতে পারে না। সরকারি আর্থিক পরিসংখ্যান, বৈদেশিক বাণিজ্য তথ্য এবং আর্থিক খাতের ডেটায় কিছু অগ্রগতি থাকলেও, সেখানে এখনও সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা, সময়নিষ্ঠতা এবং পরিসর নিশ্চিত হয়নি। বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্মিলিত রাজস্ব ঘাটতির তথ্য ২০১৯ সালের পর থেকে প্রকাশ হয়নি এবং আর্থিক খাতের বিশদ ডেটায় নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গৃহস্থালি খাতের তথ্য অপর্যাপ্ত।

তবে সব সমালোচনার মধ্যেও আইএমএফ জানিয়েছে, ভারতের সামগ্রিক ডেটা কাঠামোর গ্রেড ‘B’, অর্থাৎ কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মোটের উপর গ্রহণযোগ্য। যদিও জাতীয় হিসাব খাতে ভারতের গ্রেড দ্বিতীয়বারের মতো ‘C’ অবস্থানে রইল। পাশাপাশি আইএমএফ স্বীকার করেছে, নতুন ভিত্তিবর্ষ চালু করা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তথ্য-পরিকাঠামো আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া এগোচ্ছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে নতুন পরিসংখ্যান পদ্ধতি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্যদিকে, ভারতের অর্থনীতি নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ মূল্যায়নে আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবর্ষে ভারতের বৃদ্ধি হবে ৬.৬% এবং পরের বছরে তা কিছুটা কমে দাঁড়াবে ৬.২%-এ। মার্কিন শুল্কনীতি, আন্তর্জাতিক  অস্থিরতা এবং ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতের রপ্তানি ও বিনিয়োগ প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে কর সংস্কার, নতুন বাণিজ্য চুক্তি, কাঠামোগত সংস্কার এবং ডিজিটাল ও উৎপাদন খাতের উত্থান আগামী বছরে বৃদ্ধিকে পুনরায় ত্বরান্বিত করতে পারে। একই সঙ্গে, নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চাইলে আরও সুদের হার কমাতে পারে বলেও পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

মোদি সরকারের কাছে এই পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে চাপ বাড়াবে, কারণ ভারতের আন্তর্জাতিক  ভাবমূর্তি যতটা দ্রুত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান করছে, পরিসংখ্যানগত দুর্বলতা তার সঙ্গে খাপ খায় না। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তথ্য ব্যবস্থার এই ঘাটতি না শুধুই নীতি নির্ধারণে বাধা তৈরি করে, বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও আন্তর্জাতিক মূল্যায়নেও প্রভাব ফেলে। তাই ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারণে বিশ্বমানের পরিসংখ্যানগত কাঠামো গড়ে তোলা ভারতের জন্য এখন আর বিকল্প নয়।