বাংলায় দু'টি প্রবাদ আছে 'নেপোয় মারে দই', এবং 'যার ভাগ্যে যে খায়', 'দ্য অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টস' দেখে এই কথা দু'টোই মাথায় আসা উচিত। জয়ব্রত দাস পরিচালিত 'দ্য অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টস' হাসাতে হাসাতে কখন যে শিউরে ওঠাবে, ধরা দায়! অভিনয়, থেকে গল্প, চিত্রনাট্য থেকে গান- সব মিলিয়ে কেমন হল এই ছবি? দেখলেন শুভস্মিতা কাঞ্জি।
ধরুন আপনি কোনও একটা জিনিসের খোঁজ করছেন, কপাল জোরে পেয়েও গেলেন সেটা। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আপনারই চোখের সামনে সেটা অন্য কারও হয়ে গেল, আর আপনি সেটা ধরতেও পারলেন না। মাঝখান থেকে কিছু ধুমধাড়াক্কা মারপিট করে ফেললেন, কিছু সময়ের অপচয় হল। আর লাভের লাভ? ঘেঁচু। 'দ্য অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টস' নিয়ে বলতে গেলে, এটুকু বলা যায়। মানে ওই সারমর্ম আর কী! কিন্তু ছবি মোটেই এত সহজ নয়, আরও সহজ নয় এর চরিত্ররা। তবে আপাতভাবে নৃশংস, আজগুবি এই গল্পে প্রবলভাবে রয়েছে একজনের ছবির প্রভাব। কার? আমেরিকান পরিচালক কুয়েন্টিন তারান্তিনোর। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু মেটাফর।
কী নিয়ে 'দ্য অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টস', আর কেনই বা এমন নাম? এই ছবির গল্পের নায়ক একজনই ম্যাকগাফিন। না তার কাজ নেই, কিন্তু তাকে ঘিরেই সব! কী এই ম্যাকগাফিন? একটি মদের বোতল। তাই নিয়ে কীসের এত হইচই? কারণ এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের, স্তালিনের জন্য বিশেষ ভাবে বানানো হয়েছিল। বর্তমানে, আহা মানে গল্পে এক পিস বোতলই রয়েছে। দাম মাত্র কুড়ি কোটি টাকা। এই ম্যাকগাফিন চুরি যায় কলকাতার এক মস্তান কিমলিংয়ের (সুদীপ মুখোপাধ্যায়) বাড়ি থেকে। তিনি সেই বোতল যেন-তেন প্রকারে ফিরে পেতে মরিয়া। বোতল উদ্ধার করে আনার ভার দিলেন তাঁর দলের দীনবন্ধু মিত্র (রুদ্রনীল ঘোষ), জীবন দাস (সৌরভ দাস), রাখাল পাকড়াশি (রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়), সচিন তলাপাত্র (ঋষভ বসু), বীরেশ্বর (অমিত সাহা)-র উপর। সেই বোতল উদ্ধার করতে গিয়ে দর্শকদের আলাপ হয় রিচা (পায়েল সরকার), এষা (অনুরাধা মুখোপাধ্যায়)-র সঙ্গেও। শেষ পর্যন্ত ম্যাকগাফিনকে উদ্ধার করা যায় কিনা, চরিত্রদেরই বা কী হয় সেটা জানতে গেলে ছবি দেখতে হবে। আর যে চরিত্রদের সঙ্গে দর্শকদের আলাপ ঘটল, এরা প্রত্যেকেই শিল্পী, অদ্ভুত তাদের সেই সব গুণ, তাই এমন নাম ছবির!
এই ছবিতে রুদ্রনীল ঘোষের চরিত্রের নাম কেন জানি না মনে হচ্ছে বেশ ভেবে চিন্তেই দীনবন্ধু মিত্র রাখা হয়েছে। কেন? 'জ্যাঙ্গো'র সঙ্গে আলাপ আছে নিশ্চয়? প্রথমেই যাঁর নাম করা হল, সেই তারান্তিনোর জনপ্রিয় ছবি 'জ্যাঙ্গো আনচেইন্ড'-এর মতো বাংলাতেও জ্যাঙ্গোরা ছিলেন। আর এই জ্যাঙ্গোদের কথা উঠে এসেছে দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ বইতে। তবে কি সেই ভাবনা থেকেই রুদ্রনীলের চরিত্রের নাম এমন রাখা? হতেই পারে। দীনবন্ধু মিত্রের চরিত্রে রুদ্রনীল ওই যাকে বলে একদম খাপে খাপ। গোটা ছবিটার কথক তিনিই। তাঁর চোখ দিয়েই গল্প দেখবেন, শুনবেন দর্শকরা। তাঁর রসবোধ থেকে রাগ, সবটাই সাবলীলভাবে চরিত্রের প্রয়োজনে সময় সময়ে ফুটে উঠেছে। তাঁর 'পসন্দিদা ঔরত' হল এষা, মানে অনুরাধা। আপাতভাবে নিরীহ এক ডিভোর্সী। দীনবন্ধুর সহকর্মী জীবন দাস ভীষণ প্রফেশনাল। কেবল মাথাটা একটু গরম এই যা। মেয়েদের উপর অত্যাচার, মিথ্যে দেখলেই একটু মেরে-টেরে বা খুন-টুন করে দেয়। এই চরিত্রে সৌরভ দাস একদম যথাযথ। কখনও কখনও মন্টু পাইলট এর রূপ মনের কোথাও উঁকি দিচ্ছিল যেন।
এই দলের তৃতীয় মাথা, রমণীতে আসক্ত সচিন। না, নামের মতো, ব্যাট বল নিয়ে মাঠ কাঁপায় না সে। বরং সঙ্গীদের উদ্ভট সাজিয়ে সে খাটেই ঝড় তুলতে ভালবাসে। আর পারে দারুণ গাড়ি চালাতে। সিনেমাটা দেখার পর একটাই কথা মনে হবে, এই চরিত্রটা ঋষভ ছাড়া আর কাউকেই মানাত না। এতটাই নিখুঁত তাঁর অভিনয়। এদের দলের চতুর্থ স্তম্ভ হল বীরেশ্বর। মাংসই তার দুর্বলতা, মাংসই তার কামনা, মাংসই....। যাক গে, এই মাংসের লোভেই জিভ খুইয়েছে সে। তবুও তার মাংস চাই চাই। আর রয়েছে, এক উদ্ভট, পৈশাচিক শখ। কী? বলে দিলে ছবি দেখবেন কেন? এই বীরেশ্বরের কোনও সংলাপ নেই, কিন্তু তাঁর শরীরী ভাষা, অভিনয়, কাণ্ডকারখানাই ছবির প্রাণ। বলা যায় 'চেরি অন দ্য টপ'।
আর এরা চারজনই কাজ করে কিমলিংয়ের জন্য। এই চরিত্রে সুদীপ মুখোপাধ্যায় একদম পারফেক্ট। দোর্দণ্ডপ্রতাপ থেকে গল্পের শেষ দিকে তাঁর চরিত্রের এক অদ্ভুত বদল নিপাটভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন পর্দায়। সেই কিমলিংয়ের পছন্দের মানুষ রিচা। জটিল, অতি বুদ্ধিমান, সাহসী, এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যা খুশি করতে পারা এই চরিত্রে পায়েল নজর কেড়েছেন। এ হেন রিচার দাদা হল (?) রাখাল, অর্থাৎ রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। অল্প সময়ে নজর কেড়েছেন তিনিও।
এরা সবাই গোটা ছবি জুড়ে একটা জিনিসের পিছনেই পড়ে থাকে। এক পিস দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য ম্যাকগাফিনের বোতল। সেই ম্যাকগাফিন নিয়ে চরিত্ররা চিন্তিত হলেও, দর্শকরা মোটেই চিন্তিত নয়। তাঁদের চিন্তা একটাই কী হয় এবার, কী হয়...। এই 'কী হয় এবার'ই যেন গোটা ছবির চালিকাশক্তি। ইন্টারভেল এলেও মনে হয়, ধুত বাবা, কখন শেষ হবে!
গল্পের জোর এতটাই যে ছবি কোথাও এতটুকু ঝিমিয়ে পড়েনি। কিছু ক্ষেত্রে এডিটিং দেখে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু সেটাকে আব্বুলিশ করে দেওয়াই যায় অভিনেতার অভিনয়ের ম্যাজিক, পরিচালকের গল্প বলার ধরন এবং গল্পের জন্য। ছবি দেখতে দেখতে দর্শকরা কখন শিউরে উঠবেন নিজেরাই বুঝতে পারবেন না।
চার মক্কেল অবলীলায় 'আমরা মারধর করি না', 'শান্ত মানুষ' গোছের বুলি আওড়ে অবলীলায় নৃশংসভাবে মানুষ খুন করে ফেলে তারা। সেই দৃশ্য দেখলে কখনও ঘেন্না হয়, কখনও তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেটা উপভোগ করা যায়।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আলাদা ভাবে প্রশংসার দাবি রাখে এই ছবি। 'এমন মধুর সন্ধ্যায়' বাজতে বাজতে খুন, কল্পনা করেছেন কখনও? 'চুরি ছাড়া কাজ নেই' থেকে 'দিল ধকধক করনে লাগা' গানগুলোর মতো ৮০-৯০ দশকের একাধিক গানকে অত্যন্ত বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে কী বলা যায়? পাল্প ফিকশন নিয়ে বাংলা সিনেমায় সেই অর্থে কাজ হয়নি বললেই চলে। 'বাদামি হায়নার রহস্য' সহ হাতে গোনা এক-দু'টো ছবিই রয়েছে। এবার তাতে যোগ হল আরও একটা নাম, 'দ্য অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টস'। অবশ্য, এই ছবিকে পুরোপুরি পাল্প ফিকশন বলা যায় কিনা, তাই নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে প্রভাব? আলবাত আছে।
সিনেমা বিনোদন দেয়, আর এই ছবি ভরপুর বিনোদন দিয়েছে। যুক্তি, তক্কো বাদ দিয়ে, দুই আড়াই ঘণ্টা স্রেফ উপভোগ করা। ছাত্রছাত্রীরা যদি এই ছবি বানায়, না জানি ওঁরা পাশ করে কী ছবি বানাবেন! মন ভাল করা এই ছবিকে দশে নয় দেওয়াই যায়।
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ভুলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে এই ছবি দেখার চেষ্টা করবেন না।
