আজকাল ওয়েবডেস্ক: ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি অল্প ব্যবধানে ক্ষমতায় এলেও, পরবর্তী সময়ে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের ফলাফল দেশজুড়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, মোদী সরকারের ২০২৩ সালে পাস করানো নতুন আইন— Chief Election Commissioner and Other Election Commissioners (Appointment, Conditions of Service and Term of Office) Act— নির্বাচন কমিশনকে কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেলেছে। এই আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া থেকে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়া হয় এবং তাঁর জায়গায় প্রধানমন্ত্রী মনোনীত এক মন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এর ফলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধিকার কার্যত খর্ব হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

বিতর্ক শুরু হয়েছিল আরও আগে, ২০২২ সালে অরুণ গোয়েলের হঠাৎ অবসরের পরদিনই তাঁকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে। ২০২৪ সালের মার্চে তিনি রহস্যজনকভাবে পদত্যাগ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সাইপ্রাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পান। বিরোধীদের দাবি, এই উদাহরণ প্রমাণ করে যে নির্বাচন কমিশনার পদ আজ পার্টি-আনুগত্যের পুরস্কার মাত্র, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার দায়িত্ব নয়।

আরও পড়ুন: জঙ্গি নয়, কাশ্মীরে রাষ্ট্রের হাতে নিহতরা বাদ পড়লেন পুনর্বাসন নীতির বাইরে

লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর কংগ্রেস একাধিক কেন্দ্রে ভোটার তালিকায় অস্বাভাবিক গরমিলের অভিযোগ তোলে। কোথাও বৈধ ভোটারের নাম উধাও, আবার কোথাও একাধিক ভুয়ো নাম বহাল। সন্দেহজনকভাবে কম ব্যবধানের জয়ে বিজেপি একাধিক আসন পায়। বিরোধীরা বারবার ভিভিপ্যাট স্লিপের শতভাগ যাচাইয়ের দাবি জানালেও কমিশন তা খারিজ করে দেয়। অক্টোবর ২০২৪-এ হরিয়ানা বিধানসভা ভোটে প্রবল বিরোধী হাওয়া থাকা সত্ত্বেও বিজেপি প্রত্যাশার বাইরে ভালো ফল করে। অভিযোগ ওঠে ভোটার তালিকা হেরফের, পোস্টাল ব্যালটে গরমিল ও গোপনীয় তথ্য প্রকাশে বিলম্বের।

সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ফল আসে মহারাষ্ট্রে। লোকসভা ভোটে মাত্র ১৭টি আসনে জেতা বিজেপি-শিন্ডে জোট বিধানসভা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত সাফল্য পায়। বিরোধীরা অভিযোগ তোলে যে ভোট শেষ হওয়ার পর রাতারাতি অস্বাভাবিক হারে ভোটদানের সংখ্যা বেড়ে যায়। কংগ্রেস ভিডিও ফুটেজ দেখতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার ব্যঙ্গাত্মক সুরে দাবি করেন— সব ফুটেজ খতিয়ে দেখতে ৩,৬০০ বছর লাগবে! এই বক্তব্যে কমিশনের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আরও প্রকট হয়। বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রাথমিকভাবে এগিয়ে থাকলেও শেষ মুহূর্তে বিজেপি জিতে যায়। কংগ্রেস তদন্তে প্রকাশ পায়— এক লক্ষেরও বেশি সন্দেহজনক এন্ট্রি ভোটার তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে হাজার হাজার ভুয়ো ঠিকানা, ডুপ্লিকেট নাম, অস্বাভাবিক সংখ্যক ভোটার এক বাড়িতে নিবন্ধন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। কমিশন ডিজিটাল ভোটার লিস্ট দিতে অস্বীকার করে, ফলে অভিযোগ আরও জোরদার হয়।


মোদি সরকারের নতুন আইনে নিযুক্ত প্রথম কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের আচরণ বিরোধী শিবিরের মতে আরও পক্ষপাতদুষ্ট। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ডেকে তিনি তাঁদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে শেষে কেবল একজন প্রতিনিধিকে দেখা করার অনুমতি দেন। পরে বিরোধীরা বাইরে সাংবাদিকদের জানান— এই আচরণ নির্বাচন কমিশনের মর্যাদার পরিপন্থী। সবচেয়ে উদ্বেগজনক অভিযোগ উঠেছে বিহারে, যেখানে Special Intensive Revision (SIR) নামের প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই ৬৫ লক্ষ নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে চূড়ান্ত সংখ্যা এক কোটি ছাড়াতে পারে। বাদ পড়া অধিকাংশই দরিদ্র ও প্রান্তিক সমাজের মানুষ, যাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি রেশন কার্ড ও অন্যান্য কল্যাণমূলক সুবিধাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞ ও বিরোধী দলের বক্তব্য, মোদী সরকার কার্যত নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের দখলে নিয়েছে। ভোট যেভাবেই হোক, চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার ক্ষমতা কমিশনের হাতে— আর কমিশন যদি শাসক দলের স্বার্থেই কাজ করে, তবে সাধারণ ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন কার্যত অসম্ভব হয়ে উঠবে। ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। একজন কংগ্রেস নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যে নির্বাচন কমিশন একসময় নিরপেক্ষতার জন্য বিশ্বে দৃষ্টান্ত ছিল, আজ তা বিজেপির রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে উঠেছে।” এ অবস্থায় রাজনৈতিক মহল জিজ্ঞেস করছে— ভারতের গণতন্ত্র কি সত্যিই এক “অন্ত্যেষ্টির” দিকে এগোচ্ছে?