আজকাল ওয়েবডেস্ক: জম্মু ও কাশ্মীরের পাহাড়ি অঞ্চলে পশুপালকদের মৌসুমি গমনাগমন—যা স্থানীয়ভাবে “ট্রান্সহিউম্যান্স” নামে পরিচিত—প্রতি বছর প্রায় ১০,৮০০ কোটি টাকার “ইকোসিস্টেম সার্ভিস” বা পরিবেশগত সেবা প্রদান করে, যা পশ্চিম হিমালয়ের ভঙ্গুর জলবায়ুগত ভারসাম্য রক্ষা ও পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনটাই দাবি করা হয়েছে একটি নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে, যা এখনও প্রকাশিত না হলেও  ভারতীয় পত্রিকা তা পর্যালোচনার সুযোগ পেয়েছে।

রিপোর্টটি গুজর, বকরওয়াল, গাড্ডি ও সিপ্পি সম্প্রদায়ভুক্ত প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার পশুপালকের অর্থনৈতিক অবদানকে পরিমাপ করেছে। এই সম্প্রদায়গুলো বছরের নির্দিষ্ট সময়ে উপত্যকা অঞ্চল থেকে উঁচু পাহাড়ে ও পরে আবার নিচে নেমে আসে—এই গমনাগমনই পরিবেশের পুনর্জীবন ঘটায় বলে দাবি করা হয়েছে।

রিপোর্টের শিরোনাম—“How Can India Recognise and Integrate the Ecosystem Services of Transhumant Pastoralist Communities into Climate and Environmental Policy”—এবং এটি রচনা করেছেন জম্মু ও কাশ্মীর ক্যাডারের ২০০৯ ব্যাচের আইএএস অফিসার শাহিদ চৌধুরী, যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অফ গভর্নমেন্ট থেকে জননীতি বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন। এই গবেষণা অক্সফোর্ড ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

রিপোর্টটি জানাচ্ছে, এই যাযাবর সম্প্রদায়গুলির গমনাগমন শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক চক্র, যা পাহাড়ি নদী অববাহিকাগুলিকে স্থিতিশীল রাখে, বনভূমি রক্ষা করে ও ভূমিক্ষয় রোধ করে। রিপোর্টের হিসাব অনুযায়ী, এই “গ্রেজিং-লিঙ্কড ইকোসিস্টেম সার্ভিস” বা চারণভূমি-নির্ভর পরিবেশগত সেবার বার্ষিক আর্থিক মূল্য প্রায় ৮,৪০০ কোটি টাকা, যা ১২ লক্ষ হেক্টর জমির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়েছে।

এছাড়া বন আগুন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রায় ১২৫ কোটি টাকার সেবা এই সম্প্রদায়গুলি প্রদান করে থাকে। আবার জলাধার সংরক্ষণ, মাটিক্ষয় রোধ ও ভূগর্ভস্থ জলের পুনরায় চার্জের মাধ্যমে প্রায় ৯৬০ থেকে ১,২০০ কোটি টাকার পরিবেশগত সুফল তৈরি হয়। রিপোর্টটি আরও উল্লেখ করেছে যে, এতে কার্বন শোষণ (carbon sequestration) ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আর্থিক মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, ফলে প্রকৃত মূল্য আরও অনেক বেশি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, “এই সম্প্রদায়গুলিকে কেবলমাত্র সরকারী অনুদাননির্ভর গরিব গোষ্ঠী হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে, তারা আসলে ভারতের পরিবেশ ও জলবায়ু ব্যবস্থার রক্ষক।” শাহিদ চৌধুরী বলেন, “তাঁরা অতীতের অবশিষ্ট জীবিকা নয়, বরং ভারতের পরিবেশগত ভবিষ্যৎ নির্মাণের অপরিহার্য অংশীদার। তাঁদের গতিশীলতা পাহাড়ি পরিবেশকে জীবিত রাখে এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে।”

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই যাযাবর গমনাগমন ১৯শ শতাব্দী থেকে চলে আসছে এবং আজও চেনাব, ঝেলম, সিন্ধু ও রবি নদী অববাহিকার উচ্চভূমি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে। পশুদের চলাচলের ফলে বীজ ছড়িয়ে পড়ে, মলমূত্র মাটিতে পুষ্টি যোগায়, যা মাটির আর্দ্রতা ও সবুজ আচ্ছাদন বজায় রাখে।

রিপোর্টে সুইজারল্যান্ড, কেনিয়া ও পেরুর উদাহরণ টেনে বলা হয়েছে, সেখানে পশুপালক সম্প্রদায়গুলোকে তাদের পরিবেশ রক্ষার কাজে আর্থিক ভর্তুকি, নগদ স্থানান্তর ও কার্বন ক্রেডিট প্রকল্পের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়। ভারতেও একই নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন লেখক।

জাতিসংঘ ২০২৬ সালকে “আন্তর্জাতিক চারণভূমি ও পশুপালক বর্ষ” (International Year of Rangelands and Pastoralists) হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে রিপোর্টে ভারতের সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তারা দেশের ৪০ শতাংশ জমি জুড়ে থাকা চারণভূমির গুরুত্ব ও তাতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অবদান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনার উদ্যোগ নেয়।

২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের পর জম্মু ও কাশ্মীরের এই পশুপালক সম্প্রদায়গুলি প্রশাসনের চাপের মুখে পড়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বনভূমি দখলের অভিযোগ উঠেছে এবং অনেক এলাকায় নিরাপত্তা সংস্থার অভিযানও তীব্র হয়েছে।

যদিও ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন (Forest Rights Act), যা ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে কার্যকর হয়, আদিবাসী ও ঐতিহ্যবাহী বনবাসীদের ভূমি, চারণভূমি ও বন ব্যবস্থাপনার অধিকার দেয়, তথাপি বাস্তবে ৮৭ শতাংশের বেশি আবেদন বাতিল হয়েছে বলে অভিযোগ। বহু পশুপালককে উচ্ছেদও করা হয়েছে।

রিপোর্টটি সরকারের কাছে পরামর্শ দিয়েছে, পশুপালক সংগঠন, পঞ্চায়েত এবং প্রশাসনিক দপ্তরগুলির মধ্যে “প্রাতিষ্ঠানিক সহ-শাসনব্যবস্থা (institutional co-governance)” গড়ে তোলার, যাতে এই সম্প্রদায়গুলির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা জলবায়ু নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

শাহিদ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, “বছরের পর বছর প্রমাণভিত্তিক নীতি পরিকল্পনার অভাবে এই জনগোষ্ঠী মৌলিক নাগরিক সুবিধা—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে তাঁদের পরিবেশ রক্ষাকারী ভূমিকা স্বীকার করে জাতীয় উন্নয়ননীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার।”

এই ৩০-পৃষ্ঠার রিপোর্টটি ভারতের নীতি-নির্ধারণে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে—যেখানে যাযাবর পশুপালকদের দেখা হচ্ছে শুধুমাত্র সহায়তা-নির্ভর গোষ্ঠী হিসেবে নয়, বরং জলবায়ু স্থিতিশীলতার রক্ষক হিসেবে। পশ্চিম হিমালয়ের এই সম্প্রদায়গুলির অবদান স্বীকৃতি পেলে, তা কেবল পরিবেশ নয়, ভারতের ভবিষ্যৎ জলবায়ু কৌশলকেও আরও শক্তিশালী করবে।