আজকাল ওয়েবডেস্ক: রোগের চিন্তা, অপারেশন থিয়েটারের উজ্জ্বল আলো, যন্ত্রপাতির টুংটাং শব্দ আর নাকে ভেসে আসা ওষুধের তীব্র গন্ধ- এই পরিবেশ যে কোনও বয়সের মানুষকেই বিচলিত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু জানেন কি এমন মুহূর্তে যদি রোগী একটি বিশেষ কথা বলেন, তবে বহু ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার থেকে পিছিয়ে আসেন চিকিৎসকেরা?
কী সেই কথা?
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অপারেশন থিয়েটারে যদি রোগী হঠাৎ তাঁর ছেলেবেলার কোনও গল্প বলতে শুরু করেন, তবে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসকও নাকি অস্ত্রোপচারে ইতস্তত করেন। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি ভিত্তিহীন ধারণা বা নিছক কল্পনা বলে মনে হলেও, এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং চিকিৎসাগত তাৎপর্য।
কেন ইতস্তত করেন চিকিৎসকেরা?
প্রথমত, চিকিৎসকদের রোগীর মানসিক অবস্থা বুঝে কাজ করতে হয়। অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর মনস্তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল ও সংবেদনশীল থাকে। এই সময় শৈশবের স্মৃতিচারণাকে মনোবিদরা এক ধরনের ‘রিগ্রেশন’ বা পশ্চাদপসরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। অর্থাৎ, রোগী বর্তমানের কঠিন পরিস্থিতি থেকে মানসিকভাবে পালিয়ে শৈশবের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেতে চাইছেন। এটি চরম উদ্বেগ, ভয় এবং অসহায়ত্বের লক্ষণ। একজন চিকিৎসক যখন দেখেন যে তাঁর রোগী মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে তিনি বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন, তখন তিনি রোগীর শারীরিক ও মানসিক স্থিতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল ‘অ্যানেসথেসিয়া’ বা অবশ করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে এর সংযোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে, অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধ কীভাবে কাজ করবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। রোগীর রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে, যা অস্ত্রোপচারের সময় ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শৈশবের কথা বলাটা যদি রোগীর এই অন্তর্নিহিত উদ্বেগেরই প্রতিফলন হয়, তবে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে মানসিক ভাবে স্থিতিশীল করার জন্য কিছুটা সময় নিতে চাইতে পারেন।
তৃতীয়ত, এটি রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যেকার আস্থার সম্পর্ককেও নির্দেশ করে। একজন রোগী যখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত ও দুর্বল মুহূর্তের কথা একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ভাগ করে নেন, তখন এটি তাঁদের মধ্যে একটি মানবিক সেতু তৈরি করে। কিন্তু অস্ত্রোপচারের ঠিক আগে এই ধরনের আবেগঘন পরিস্থিতি চিকিৎসকের মনকেও প্রভাবিত করতে পারে। শল্যচিকিৎসা একটি অত্যন্ত নিপুণ এবং মনঃসংযোগের কাজ। এই সময় চিকিৎসকের নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। রোগীর মানসিক দুর্বলতা যদি চিকিৎসককে সামান্যতমও বিচলিত করে, তবে তার প্রভাব অস্ত্রোপচারের ফলাফলের উপর পড়তে পারে। তাই অনেক চিকিৎসক এই ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চান এবং রোগীকে আশ্বস্ত করে তাঁর মনোবল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।

তবে এর অর্থ এই নয় যে, চিকিৎসকেরা অনুভূতিহীন। বরং, তাঁরা রোগীর প্রতি অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ থেকেই এই সতর্কতা অবলম্বন করেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য থাকে, যে কোনও মূল্যে রোগীর জীবন রক্ষা করা এবং অস্ত্রোপচারকে সফল করা। তাই রোগীর বলা শৈশবের গল্প হয়তো তাঁদের কানে মধুর শোনায়, কিন্তু তাঁদের প্রশিক্ষিত মন সেই গল্পের আড়ালে থাকা বিপদের সঙ্কেতটিকে উপেক্ষা করতে পারে না। সব মিলিয়ে, এটি নিছক একটি গল্প নয়, বরং চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক অধ্যায়ের বাস্তব প্রতিফলন।
