আজকাল ওয়েবডেস্ক: হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক সাধারণত হঠাৎ ঘটে যাওয়া জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, এর আগেই শরীরে নীরবে শুরু হয় ধীরগতি এক পরিবর্তন। আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রকল্প CARDIA (Coronary Artery Risk Development in Young Adults)-এর বিশ্লেষণ বলছে, হার্টের অসুখ ধরা পড়ার প্রায় ১২ বছর আগে থেকেই মানুষের শারীরিক সক্ষমতা বা শ্বাসকষ্ট ছাড়া সক্রিয় থাকার ক্ষমতা (moderate-to-vigorous physical activity, MVPA) ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। আর রোগ ধরা পড়ার আগের শেষ দুই বছরে এই সক্ষমতা দ্রুত হারে কমে যায়।
ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া শক্তি
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ পরবর্তীতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের শারীরিক পরিশ্রম সহ্য করার ক্ষমতা দীর্ঘদিন ধরেই কমতে থাকে। একে সাধারণ বার্ধক্য ভেবে অনেকেই গুরুত্ব দেন না। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলোকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা জরুরি। হায়দরাবাদের অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সুধীর কুমার সতর্ক করেছেন— “শ্বাসকষ্ট, দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া বা আগের মতো হাঁটতে বা ব্যায়াম করতে না পারা—এসবকে যদি আমরা কেবল বয়সজনিত পরিবর্তন ভেবে এড়িয়ে যাই, তাহলে একটি বড় সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়েই সনাক্ত করতে পারলে ওষুধ, জীবনযাপন পরিবর্তন কিংবা স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে বড় ধরনের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
কীভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হয় ঝুঁকি?
গবেষকরা জানাচ্ছেন, শারীরিক সক্রিয়তা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বেশ কিছু ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটে—
কার্ডিয়াক ডিকন্ডিশনিং: হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা ও ফুসফুসের সহনশীলতা কমতে থাকে।
রক্তনালীর ক্ষয়: চলাফেরা কম হলে রক্তনালীর ভেতরে চর্বি জমে ধমনী শক্ত হয়ে যায়।
মেটাবলিক সমস্যা: ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, কোলেস্টেরল বাড়া—সবই হৃদরোগকে কাছে ডাকে।
প্রদাহ ও স্নায়বিক ভারসাম্যহীনতা: নড়াচড়া কম হলে শরীরে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ বাড়ে, হৃদস্পন্দনের স্বাভাবিক ছন্দও নষ্ট হয়।
আরও পড়ুন: তরুণ প্রজন্মের মলদ্বারে বাসা বাঁধছে এই মারণ রোগ! চারটি সতর্কবার্তা চিহ্নিত করলেন গবেষকরা
কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন?
CARDIA-র তথ্য বলছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব গোষ্ঠীতেই শারীরিক সক্রিয়তা কমলেও, লিঙ্গ ও জাতিগত বিভাজনে পার্থক্য আছে। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের মধ্যে শারীরিক সক্রিয়তা সবচেয়ে কম দেখা গেছে। ফলে এই গোষ্ঠীগুলি তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। গবেষকরা মনে করছেন, শুধুমাত্র সাধারণ পরামর্শ দিলেই হবে না; সংস্কৃতি, সমাজ ও বাস্তব পরিস্থিতি মাথায় রেখে আলাদা পরিকল্পনা করা জরুরি।
চিকিৎসকদের করণীয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোগ নির্ণয়ে কেবল একদিনের ডেটা যথেষ্ট নয়। বরং দীর্ঘ কয়েক বছরের পরিবর্তনের ধারা (trajectory) দেখাই আসল চাবিকাঠি। এজন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ:
রোগীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ও সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হবে।
রক্তচাপ, বিএমআই, লিপিড প্রোফাইল, শর্করা পরীক্ষার মতো সাধারণ স্ক্রিনিং করতে হবে।
প্রয়োজনে ঝুঁকি মাপার টুল (ASCVD risk estimator) ব্যবহার করতে হবে।
হালকা হাঁটা বা পরিশ্রম সহ্য করার ক্ষমতা যাচাই করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য নির্দেশনা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি মাত্রার শারীরিক কার্যকলাপ (যেমন brisk walking, সাইক্লিং, সাঁতার) বা ৭৫ মিনিট উচ্চমাত্রার কার্যকলাপ করার পরামর্শ দিয়েছে।
সাধারণ মানুষ কী করতে পারেন?
প্রতিদিনের কাজের মধ্যে হাঁটা বা সাইকেল চালানো অভ্যাসে পরিণত করুন।
একটানা না পারলে দিনে অল্প অল্প সময় ভাগ করে ব্যায়াম করুন।
লিফট বাদ দিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, অফিসে বা বাড়িতে দীর্ঘক্ষণ বসে না থেকে দাঁড়িয়ে কাজ করুন।
যেসব কাজ ভালো লাগে (নাচ, সাঁতার, খেলা)—সেগুলোই নিয়মিত করুন, এতে অভ্যাস টিকে যায়।
প্রতিবন্ধকতা থাকলে (সময় সংকট, নিরাপদ জায়গার অভাব, শারীরিক ব্যথা) সেগুলো মোকাবিলায় বিকল্প খুঁজুন বা চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
হার্ট অ্যাটাকের আগে অনেক দীর্ঘ সময় ধরে শরীর নীরবে সংকেত পাঠায়। শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি বা ব্যায়াম কমে যাওয়া যেন বয়সের অজুহাতে চাপা না পড়ে যায়—এই বিষয়টি চিকিৎসক ও রোগী উভয়েরই মনে রাখা দরকার। আগে থেকে সচেতন হলে এবং জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা গেলে, হৃদরোগের মতো প্রাণঘাতী অসুখ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
