আজকাল ওয়েবডেস্ক: মধু—একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি তরল, যা মৌমাছি ফুলের মধুরস থেকে তৈরি করে—বিশ্বজুড়ে ওষুধি গুণের জন্য সুপরিচিত। শতাধিক প্রজাতির মধুর মধ্যে বেশিরভাগই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু এমন একটি মধু আছে, যা যেমন যৌন উত্তেজক, তেমনই অতিরিক্ত গ্রহণ প্রাণঘাতীও হতে পারে। এই মধুর নাম ‘ম্যাড হানি’ বা ‘পাগলা মধু’, যা শুধুমাত্র নেপাল ও তুরস্কে উৎপন্ন হয়।

হিমালয়ের উঁচু অঞ্চলে বসবাসকারী বিশালাকৃতি মৌমাছিরা রডোডেনড্রন ফুলের মধু ও পরাগরেণু থেকে এই বিশেষ মধু তৈরি করে। এতে থাকে গ্রায়ানোটক্সিন (Grayanotoxin) নামের এক রাসায়নিক যৌগ, যা শরীরে নেশাসদৃশ প্রভাব ফেলে এবং অতিরিক্ত মাত্রায় বিষক্রিয়াও ঘটাতে পারে।

এই মধুর ইতিহাসও প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০১ সালে গ্রিক সেনানায়ক জেনোফন তাঁর Anabasis গ্রন্থে এই মধুর কথা উল্লেখ করেন, যেখানে সৈন্যরা এটি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫ সালে, রাজা মিত্রিদাতেস রোমান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় এই মধু ব্যবহার করেছিলেন এক ধরনের জৈব অস্ত্র হিসেবে।

১৮শ শতকে ইউরোপে এই মধু ছিল এক সময় পানীয় তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

নেপাল ও ভারতের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হিন্দুকুশ-হিমালয় অঞ্চলে বসবাসকারী গুরুঙ উপজাতি, যারা মূলত তিব্বতি বংশোদ্ভূত, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মধু সংগ্রহ করে আসছে।

তারা দড়ির মই বেয়ে ১,২০০ থেকে ৪,০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত পাহাড়ি খাদের কিনারে গিয়ে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছিদের দূরে সরাতে তারা নিচ থেকে ধোঁয়া দেয়। তবে বর্তমানে অতিরিক্ত শিকার, সড়ক নির্মাণ ও বাঁধ তৈরির কারণে মৌচাকের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।

Science Direct-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বছরে বছরে এই পাহাড়ি মৌচাকের সংখ্যা ও মৌমাছির কলোনি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এখন ৫০০ গ্রাম মধুর দাম প্রায় নেপালি তাকে ৪,০০০–৪,৫০০ (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ₹২,৫০০–₹২,৮০০)।

RSC Advances-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ম্যাড হানি সাধারণত যৌন উত্তেজক, গ্যাস্ট্রিক বা হজমজনিত সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি রোগের বিকল্প চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।” তাছাড়া এটি সর্দি-জ্বর, গলা ব্যথা, ডায়াবেটিস এবং বাতরোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন—মাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক বা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া এটি খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।

Texas Heart Institute Journal-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এক দম্পতি—স্বামী ৫০ বছর বয়সী, স্ত্রী ৪২—তুরস্কে তৈরি ম্যাড হানি এক সপ্তাহ ধরে খেয়েছিলেন যৌন জীবনে উত্তেজনা আনতে। ফলস্বরূপ, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা দুজনেই তীব্র বুকে ব্যথা ও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

ডাক্তারদের মতে, অতিরিক্ত ম্যাড হানি খেলে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে, দেখা দিতে পারে চেতনা হারানো, শ্বাসকষ্ট, হৃদস্পন্দন ধীর হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, দৃষ্টিবিভ্রম, খিঁচুনি ইত্যাদি উপসর্গ।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইউরোপের আল্পস বা পিরেনিস পর্বতে রডোডেনড্রন ফুল থেকে তৈরি মধুতে এমন বিষাক্ত উপাদান থাকে না। কিন্তু নেপাল ও তুরস্কের ম্যাড হানি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছাড়া খাওয়া একেবারেই উচিত নয়।

মধু যেমন প্রাকৃতিক উপহার, তেমনই এটি হতে পারে বিপদের কারণ। এক চামচ ম্যাড হানি শরীরে উষ্ণতা ও উত্তেজনা আনতে পারে ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত হলে সেটিই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হতে পারে। তাই এই রহস্যময় নেপালি মধুর ক্ষেত্রে প্রাচীন কথাই আজও প্রযোজ্য—“অতি লোভে তাঁতি নষ্ট”।