২০০৯ সালের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার হুয়াচুকা পর্বতমালা ধরে হাঁটছিলেন একদল কিশোর পাখি–পর্যবেক্ষক। হঠাৎই তাদের কানে আসে এক অচেনা সুর—নরম, বাঁশির মতো স্বর, যা আশপাশের পরিচিত পাখিদের ডাকার সঙ্গে কোনোভাবেই মিলছিল না। শব্দটি ক্যানিয়নজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
2
12
দলের এক সদস্য তৎক্ষণাৎ ফোন বের করে পাখিদের ডাক খুঁজতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন সে ব্রাউন-ব্যাকড সলিটেয়ার পাখিটির ডাক বাজাল, সবাই অবাক হয়ে গেল। এটাই সেই শব্দ।
3
12
কিন্তু সমস্যা হল—ব্রাউন-ব্যাকড সলিটেয়ার পাখি সাধারণত মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার পাহাড়ি জঙ্গলে থাকে। অ্যারিজোনার সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই।
4
12
এই বিস্ময়কর মুহূর্তটিই একটি বড় প্রশ্নের সূত্রপাত ঘটায়: পাখিরা কখনও–সখনও কেন নিজেদের স্বাভাবিক বিস্তৃতির বাইরে সম্পূর্ণ অচেনা স্থানে গিয়ে উপস্থিত হয়?
5
12
এই ধরনের পথভ্রষ্ট পাখিদের বলা হয় ভ্যাগরান্ট। পাখিপ্রেমী পর্যবেক্ষকদের কাছে এগুলো রোমাঞ্চকর আবিষ্কার। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কাছে এগুলো আরও বড় কৌতূহলের উৎস—কারণ এরা ইঙ্গিত দিতে পারে পাখিদের অভিযোজন প্রক্রিয়া, বিবর্তন, এমনকি নতুন অভিবাসন পথ তৈরি হওয়ার ব্যাপারে।
6
12
ভ্যাগরান্ট আবিষ্কারের উত্তেজনা পাখিদের কাছে যেন পুরস্কার পাওয়ার মতো। কোনও বিরল পাখি “ভুল জায়গায়” দেখা গেলে খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিজ্ঞানীদের কাছে বিষয়টি ভিন্ন ধরনের চিন্তার দরজা খুলে দেয়: এই পাখিরা কি কেবল ভুল করে এসেছে? এরা কি বিবর্তনের অচল পথ? নাকি এদের মধ্যে ভবিষ্যতের অভিযোজনের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে?
7
12
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন অরনিথোলজিস্ট বেনজামিন ভ্যান ডরেন, যার প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনা ঘটে ওই ২০০৯ সালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি জায়গা প্রায়ই ভ্যাগরান্ট পাখির তালিকায় উঠে আসে—ফ্যারালন দ্বীপপুঞ্জ।
8
12
সান ফ্রান্সিস্কো উপকূল থেকে ৩০ মাইল দূরে দক্ষিণ-পূর্ব ফ্যারালন দ্বীপটি ১৯৬৭ সাল থেকে বন্যপ্রাণী গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। অভিবাসন সিজনে দ্বীপটি ভুল পথে আসা অসংখ্য পাখির আকস্মিক অবতরণস্থলে পরিণত হয়।
9
12
নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ছয় প্রজাতির আমেরিকান ওয়ার্বলার—রঙিন ও ছোট আকারের গানের পাখি—নিয়ে কাজ করেন, যারা দ্বীপে স্বাভাবিক রুট থেকে বিচ্যুত হয়ে এসে পড়েছিল। গবেষকরা সাম্প্রতিক ভ্যাগরান্টদের পালক সংগ্রহ করেন এবং একই সঙ্গে ১৮০০ সালের শেষ দিকের সংরক্ষিত নমুনাও পরীক্ষা করেন।
10
12
প্রতি পালকের ভেতরে থাকে এক ধরনের “গোপন জিপিএস”—স্যাটেলাইট নয়, হাইড্রোজেন আইসোটোপ, বিশেষত ডিউটেরিয়াম। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জলে এই আইসোটোপের অনুপাত ভিন্ন ভিন্ন। পাখিরা যে জল ও খাদ্য গ্রহণ করে, তার আইসোটোপিক স্বাক্ষর তাদের পালকে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। এই স্বাক্ষর বিশ্লেষণ করে গবেষকরা পাখিদের উৎস অঞ্চল নির্ধারণ করেন।
11
12
ফলাফল জানায়: ছয়টি ওয়ার্বলার প্রজাতিই এসেছে তাদের প্রজনন অঞ্চলের পশ্চিমাংশ থেকে, অর্থাৎ কানাডার বিস্তৃত বোরিয়াল অরণ্য থেকে। এই পশ্চিমের জনসংখ্যা পূর্বাঞ্চলের তুলনায় আকারে ছোট।
12
12
ভ্যান ডরেন বলেন, “অনেকে ভাবতে পারেন, কোনও পাখিই এলোমেলোভাবে যেকোনো দিকে উড়ে গিয়ে যেকোনো জায়গায় পড়তে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা তা পাইনি।” আরও একটি প্রচলিত ধারণা—ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের পাখিরা বেশি পথভ্রষ্ট হয়—তাও এই গবেষণায় খণ্ডিত হয়েছে। ভ্যাগরান্টদের উপস্থিতি তাই কেবল পাখিদের রোমাঞ্চ নয়; এটি পাখির বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ অভিযোজন ক্ষমতার গভীর ইঙ্গিত বহন করতে পারে।