মা-বাবা দু’জনকেই হারিয়েছেন অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। দেবীপক্ষের শুরুতে মহালয়ার সকালে বার বার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে অভিনেত্রীর। হাতড়াচ্ছেন বাবার সঙ্গে লেগে থাকা মনকেমনের স্মৃতিও।  তাঁর ছোটবেলার মহালয়ার কাকভোরের রঙিন সব সুখজাগানিয়া স্মৃতির সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে মা-বাবা, পুরনো রেডিও, শঙ্খধ্বনি আর অনেককিছু... সেসব কথাই এদিন সাম্যমাধ্যমের পাতায় ভাগ করে নিলেন স্বস্তিকা। 


অভিনেত্রী লিখলেন - “রাজ্যের কাজ সেরে গতকাল বাড়ি ফিরে মাসি কে বললাম - রেডিওটা কোথায় গো মাসি ? ভোর হলেই তো লাগবে। বাকি বছর তো মনেই থাকেনা সে আছে কোথায়। 
মাসি উত্তরে বলল - এইখানেই থাকত, (যেন আমাদের পরিবারের আর এক সদস্য, আসবাবপত্র থাকতে থাকতে সদস্যই হয়ে যায় বটে), দাদার খুব ব্যা থা বাড়লে চালিয়ে শুনত, বলত গান শুনলে নাকি ব্যাতথা কম হয়, কিন্তু দাদা মরে যেতে আর দেখিনি। আমার কেন মনে পড়ল না জানিনা, মাসি রান্নার গ্যা স শেষ হয়ে গেলে বলতে ভুলে যায়, এটা ঠিক মনে রেখেছে। আমি হিসেব করে দেখলাম, বাবা চলে গেছে সাড়ে পাঁচ বছর আগে, মাসি কী ভেবে বলল কে জানে, মহালয়া তো মিস হয়নি একবার ও। শুরু হলো খোঁজা, বাবা গো সে কত কাজ, ঘর তোলপাড় করে সেই তো আবার সব গোছাতে হবে। মা তো নেই যে সারা বাড়ি উপরে ফেলে - মা গুছিয়ে দিয়ো মার্কা হুকুম ঝেড়ে গিয়ে শুয়ে পড়তে পারব। অবস্য মা থাকলে কোনদিন কোনও কিছুই খুঁজতে হয়নি। নাকছাপি থেকে আলপিন, বাড়ির দলিল থেকে ডেবিট কার্ড সবই মা এর আঁচল এ বাঁধা। মা চলে যেতে সেই যে খোঁজা শুরু হলো, আজও খুঁজে চলেছি। 
যাই হোক, রেডিও পাওয়া গেল। 
যাবতীয় তার, প্লাগ ইত্যাদি সেও পাওয়া গেল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আকাশবাণী কলকাতা স্টেশন রেডি করে রাখলাম। 
মা এর কথা সর্বক্ষণ মনে পড়ে, কিন্তু মহালয়া এলেই যেন গোটা ছোটবেলা, বড়বেলা টা চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। 
এক সপ্তাহ ধরে বাড়ি ঘর সব পরিষ্কার করা, বিছানায় নতুন চাদর, জানালায় নতুন পর্দা, নতুন কুশান কভার, আনাচে কানাচে থেকে ঝুল ঝাড়া, সাজো সাজো রব - মা দুর্গা এলো বলে। 

 

 

বাবা কে খুব একটা মহালয়া শুনতে দেখিনি, কিন্তু মা স্কুল এর হেডমাস্টার এর মতন, ঠিক ৩.৪৫ এ ঘুম থেকে তুলে দিতো, আমি, বোন, আমার মেয়ে সবার সঙ্গেই একই নিয়ম। 
বাইরে ঘর এ গিয়ে, কেউ সোফায়, কেউ চেয়ার এ, কেউ মেজেতে গা এলিয়ে শুনতাম। 
মা ঘর এ ধুপ দেখিয়ে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতো। পরে জিজ্ঞেস করাতে বলত - ও কিছু না। 
মা চলে যেতে সেই বছর ভয়ে রেডিও চালাইনি। উঠে পড়েছিলাম, ওটা অভ্যাস, কিন্তু চালাইনি, এমনিই একটা অজানা, অচেনা মন খারাপ হত ছোটবেলা থেকেই, যারা চলে গেছে, দিদা, দাদু, ঠাকুরদা, আম্মা, তাদের কথা ভেবে খুব কষ্ট হত আর এখন তো চেনা দুঃখ, চেনা সুখ, ভয় এ শুনিনি, মনে হত কেঁদে মরে যাব, নিজেকে কেন এত কষ্ট দেওয়া! 
আবার সেই যে শুনলাম না, সেটাও সহ্যক হলোনা, ভাবলাম মা থাকতে কোনোদিন যার অনথ্যাু হয়নি, সে না থাকতে তার বয়ে নিয়ে আসা প্রথাকে অবমাননা করব কেন? এই যে দ্বন্দ্বের দোলাচলে পরে থাকে মানুষ, এর থেকে মুক্তি নেই। 
মনে জোর এনে পরের বছর থেকে শুরু হল ভোর ৩.৪৫ এ উঠে রেডিও অন করা। 
আজও উঠলাম, অবশ্য আজ আর তেমন ঘুমইনি। 
মহালয়ার সূচনায় শাঁখটা বাজলেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয় - যা দেবী চণ্ডী মধুকৈতভ বিধ্বংসী… 
ঘরের আলো নিভিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। ভোরের একটা ভেজা সোঁদা গন্ধ হয়, আমাদের বাড়ির গেট এর বাইরে কামিনী গাছটায় ফুল হয়েছে, তারাও গন্ধ ছড়াচ্ছে, আকাশে তখনও তারা জ্বলছে টিমটিম করে। 
হাত জোর করে প্রণাম করলাম, মা দুর্গা কেও, নিজের মা কেও। বললাম আর কিছু হোক না হোক, আমার চাওয়া পাওয়ার হিসেব পরে হবে, আমার সন্তানগুলোর মঙ্গল করো মা। ওরা যেন ভালো থাকে। ওদের কৃপা কর। ওরা সুখে থাকলেই আমার সুখ। 
মানি, ফুলকি, সাবিত্রী রা যেন থাকে দুধে ভাতে। 
এত বছর ধরে ঠাহর করতে পারিনি, আজ বুঝলাম, মা কেন রেডিও শুনতে শুনতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতো। 
ও কিছু না…মা জননীরা অমন কেঁদেই থাকে। 
শুভ হোক, আলো হোক। 
শুভ মহালয়া” 

(পোস্টের বানান অপরিবর্তিত রাখা হল)

 

 

অভিনেত্রীর এই হৃদয়মথিত আবেগ জড়ানো পোস্ট মন ছুঁয়েছে নেটপাড়ার। অনেকে কমেন্টে নিজেদের মহালয়া স্মৃতি ভাগ করে নিয়েছেন। কেউ লিখেছেন, “মা-বাবার সঙ্গে মহালয়ার ভোর স্মৃতি অমূল্য, তোমার পোস্ট মনে করালো আমার ছোটবেলার দিনগুলো।”

এভাবেই মহালয়ার ভোরে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ শুধু নিজের জন্য নয়, নেটপাড়ার ফ্যানদের হৃদয়েও এক সঙ্গে ছুঁয়ে গেছে—মা-বাবার ভালবাসা, শৈশবের আনন্দ আর দেবীপক্ষের ঐতিহ্য।